Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

ফুটবলের গতিপ্রকৃতি বদলে দেয়ার প্রত্যয়ে তিনি

আহসান হাবীব সুমন/ নীলিমা তন্ময়ঃ

প্রচলিত একটা সাংস্কৃতিক পর্যায়ের মতবাদ আছে। তা হল, “একজন সফল ব্যক্তি এবং অন্যদের মধ্যে পার্থক্য  শক্তির অভাবে নয়, জ্ঞানের অভাবে নয়, বরং ইচ্ছার অভাব।”  অর্থাৎ সফলতার পথ সুমসৃণ হয়ে তখনই ধরা দেবে, যখন নিজের ইচ্ছে শক্তিটি যথার্থ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে শাণিত হয়। যেমন, একজন ইমরুল হাসান। ফুটবল সংগঠক হিসাবে নিজের জাতকে চেনাতে সক্ষম হয়েছেন। সেই তিনিই বলছেন, সাংস্কৃতিক পরিসরে অর্থাৎ ধরুন যে, ফুটবলের সাফল্য পেতে হলে প্রথমত আপনাকে ‘স্পোর্টিং ক্যারেক্টার’ তথা ক্রীড়াপ্রিয় সত্তা হতে হবে। 

মিষ্টভাষী ও সদালাপী ইমরুল জানালেন, ” খুনে কথায় বলতে গেলে, আপনাকে ফুটবল পাগল হতে হবে।  যেমনটি,  আমাদের পরম শ্রদ্ধেয়  বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ার‍ম্যান জনাব আহমেদ আকবর সোবহানের মধ্যে দেখেছি।  এখনো ম্যাচ শেষ হতে না হতে তিনি আমাকে কল করে বলেন যে, আজকে অমুক পজিশনে কিংবা কোন নির্দিষ্ট খেলোয়াড় মাঠে সেরাটা দিতে পারেনি। এর অর্থ হল, তিনি শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ী হয়েও  সময় ব্যয় করে ম্যাচ দেখেন। দ্বিতীয়ত হল, সাফল্য ঘরে তুলতে তাঁর মধ্যে উদ্বিগ্নতা কাজ করে। সত্যি বলতে,  এমন ক্রীড়াবান্ধব পরিবারের সাথে কাজ করতে যেয়েই হয়তো এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি। “ 

এদিকে ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত বসুন্ধরা কিংস ইতোমধ্যে টানা চারটি পেশাদার লীগ শিরোপা ঘরে তুলে সৃষ্টি করে নতুন ইতিহাস । বাংলাদেশের লীগ ফুটবলের ইতিহাসে কোন ক্লাবের টানা চারটি শিরোপা নেই । পেশাদার লীগে হ্যাট্রিক শিরোপা জয়ের নজীর আছে ঢাকা আবাহনী ক্রীড়া চক্রের । এছাড়া ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন লীগে টানা তিনটি করে শিরোপা জয়ের রেকর্ড মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আর আবাহনীর । বসুন্ধরা সেই রেকর্ড ভেঙ্গে পেয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব ।

পেশাদার লীগ ছাড়াও বসুন্ধরার রয়েছে দুটি করে ফেডারেশন কাপ আর স্বাধীনতা কাপ ।এমনকি , নারীদের ফুটবল লীগেও বসুন্ধরা জয় করেছে হ্যাট্রিক শিরোপা ।  অর্থাৎ বসুন্ধরা কিংস সত্যিকার অর্থেই বর্তমানে দেশের ফুটবলের ‘রাজা’ ।






বসুন্ধরা কিংস সব সময় সেরাদের নিয়েই দল গড়ে । বসুন্ধরার জার্সিতে খেলেছেন কোস্টারিকার ওয়ার্ল্ড কাপার ড্যানিয়েল কলিয়েন্দ্রেস । সর্বশেষ মৌসুমে ব্রাজিলের রবসন রবিনহো , ডরিয়েল্টন গোমেজ আর মিগুয়েল ফেরেরারা ছিলেন স্কোয়াডে । বসুন্ধরা থেকে উঠে এসেছেন হালের আলোচিত রাকিব হোসেন আর শেখ মোরসালিনের মত প্রতিশ্রুতিশীল ফুটবলার । সেই সাথে তপু বর্মণ , ইয়াসির আরাফাত , আনিসুর রহমান জিকো , বিশ্বনাথ ঘোষ , সাদউদ্দিন আর তারিক কাজীদের মত জাতীয় দলের একঝাঁক তারকা সব সময়েই আলোকিত করে রেখেছে বসুন্ধরা কিংসের স্কোয়াড । 

বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ইমরুল হাসান শুরু থেকেই দলকে দেখতে চেয়েছিলেন সেরা অবস্থানে । তাই দেশী-বিদেশী খেলোয়াড় সংগ্রহে বসুন্ধরা সব সময় সবাইকে টেক্কা দিয়েছে । ফলও মিলেছে । দেশের ফুটবলে শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার পর সভাপতি আন্তর্জাতিক ফুটবলে ওড়াতে চান বসুন্ধরার ঝাণ্ডা । যদিও প্রথমবারের এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের প্লে-অফে অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারে নি বসুন্ধরা । হেরে যায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের ক্লাব শারজাহ এফসির কাছে । তাতে দেশের প্রথম ক্লাব হিসেবে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লীগের চূড়ান্তপর্বে খেলার আশা গুঁড়িয়ে গেছে বসুন্ধরার , কিন্তু ঠাই হয়েছে এএফসি কাপে ।

ইমরুল হাসান শুধু নিজের ক্লাব না , ভাবনায় বিভোর হন দেশের ফুটবল নিয়েও । একটা সময় মোহামেডান আর আবাহনীর খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে দেখা গেছে উপচে পড়া ভিড় । দুই দলেরই ছিল অন্ধ সমর্থকদের বিরাট দল । কিন্তু বর্তমানে ফাঁকা স্টেডিয়ামে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় দুস্কর । কালে-ভদ্রে তারা মাঠে আসেন । বিষয়টি বিব্রত করে ইমরুল হাসানকে । দর্শকরাই খেলার মাঠের প্রাণ । দর্শকশুন্য স্টেডিয়ামে জয় পাওয়াতেও পরিপূর্ণ তৃপ্তি নেই । তাই তিনি মনোযোগ দিয়েছেন বসুন্ধরার সমর্থক গোষ্ঠী গড়ে তোলার কাজে । বিভিন্ন জেলায় গঠিত হয়েছে বসুন্ধরা ফ্যানস ক্লাব ।বাংলাদেশের যে কোন ফুটবল সংগঠকের চেয়ে চিন্তা-চেতনা আর পরিকল্পনায় অনেকবেশী আধুনিক বসুন্ধরা সভাপতি ইমরুল হাসান । তিনিই প্রথম দেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে নিয়ে সমর্থক গোষ্ঠী গঠনের চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন । সেই সমর্থকরা এখন বাংলাদেশের যে কোন প্রান্তে বসুন্ধরার খেলা দেখতে হাজির হয়ে যান । ক্লাবের জার্সি , পতাকা আর বাদ্যযন্ত্রে মাতিয়ে রাখেন মাঠ । বসুন্ধরার অনুসরণে এখন মোহামেডান আর আবাহনীর মত ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মনোযোগ দিয়েছে সমর্থকদের জাগিয়ে তোলার কাজে । এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঘরোয়া ফুটবলের জৌলুস না ফেরার কোন কারণ নেই ।

ইমরুল হাসান কি শুধু নিজের ক্লাব নিয়েই ভাবছেন ? না । তিনি জানেন , জাতীয় দল সাফল্য না পেলে ঘরোয়া ফুটবল জাগবে না । আর তাই তৈরি করতে হবে নতুন নতুন ফুটবলার । ইতোমধ্যে বসুন্ধরা স্পোর্টস কমপ্লেক্সের কাজ গুছিয়ে এনেছেন । ভবিষ্যতে বিদেশি কোচ দিয়ে বয়সভিত্তিক দলকে যদি দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ দিয়ে তুলে আনতে চান নতুন খেলোয়াড় । এতে বসুন্ধরার পাইপলাইনে অনেক খেলোয়াড় আসবে। সেটা শুধু বসুন্ধরার জন্য নয়, বাংলাদেশও উপকৃত হবে।

বাংলাদেশে বসুন্ধরা কিংস নিজেদের স্টেডিয়াম তৈরি করে গড়েছে ইতিহাস , যা অন্য কারো নেই ।দেশের একমাত্র পেশদার ক্লাব বসুন্ধরা যাদের আছে নিজস্ব স্টেডিয়াম । কিংস অ্যারেনা নামের স্টেডিয়াম ইতোমধ্যে পেয়েছে আন্তর্জাতিক ভেন্যুর স্বীকৃতি । সম্প্রতি আফগানিস্তানের বিপক্ষে দুটি আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে কিংস অ্যারেনায় । বলা যায় , বাংলাদেশের ফুটবল প্রবেশ করেছে নতুন যুগে ।

ইমরুল হাসান বসুন্ধরার সাফল্যের কৃতিত্ব নিজে দাবী করেন না । বসুন্ধরা মুলত কর্পোরেট হাউজ । দক্ষ জনশক্তির ব্যবহারে তারা পরিণত হয়েছে  দেশের  শীর্ষ ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানে । ক্লাব পরিচালনার ক্ষেত্রেও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগকে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করেন ইমরুল হাসান । অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে শুরু করে ক্লাবের কোচিং স্টাফ, খেলোয়াড়, সাপোর্টিং স্টাফ যারা রয়েছেন, তারা সবাই দক্ষ। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বসুন্ধরা কিংস ফলত এখন দেশের সেরা ক্লাব।

ইমরুল হাসান মনে করেন , “বর্তমান সময়ে বসুন্ধরার মতো আরও কিছু করপোরেট হাউজের  এগিয়ে আসা উচিত। তারা যদি ফুটবলে আসে তাহলে বাংলাদেশের সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করবে। কারণ পেশাদার খেলাধুলায় আর্থিক সচ্ছলতা খুব জরুরী । অনেক ঐতিহ্যবাহী ক্লাব  আর্থিক সমস্যায় হারিয়েছে অতীত গৌরবও।”  

বসুন্ধরা কিংস সভাপতি ভীষণ স্বপ্নবাজ মানুষ । তিনি  বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের  সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন । অনেকদিন ধরেই দেশের ফুটবলে বড় কোন সাফল্য নেই । যদিও চলতি বছর সাফের সেমি ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ কিছুটা সাফল্য দেখিয়েছে ।  তবু বাংলাদেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা ছাড়তে নারাজ ইমরুল । জানিয়েছেন , ‘ হ্যাঁ , দেশের ফুটবলে  অনেকদিন বড় সাফল্য নেই । কিন্তু আমি মনে করি  ব্যর্থতার সময়টা কেটে যাবে ।  আমি এটাকে শরতের মেঘ হিসেবে দেখি, বিষয়টা সাময়িক। শরতের মেঘ আকাশে বেশি সময় থাকে না, কেটে যায়। আমি আশা করছি, এই শঙ্কার মেঘ কেটে সামনে একটা সুন্দর পরিছন্ন আকাশ দেখতে পাব।’

ইমরুল বলছেন, “বাংলাদেশ দলে নতুন কোচের মাধ্যমে সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠার একটা পথ ধরা দিচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা ও শ্রম—-আমাদেরকে একদিন অনেকদূরে নিয়ে যেতে পারে। ফুটবল প্রশ্নে সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই আমাদেরকে প্রথমে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করতে হবে। এরপর নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক রেখে কাজের কাজ করার মধ্য দিয়েই আমাদের পতাকাকে বৈশ্বিক পর্যায়ে পরিচিত করাতে হবে। এমনিতে আমরা খুবই ভাল দর্শক, ফুটবলভক্ত—–কিন্তু, ফুটবলার তৈরি করা, কোচ ও সংগঠকদের নিরলস উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার মিশেলে বাংলাদেশের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ক্লাব ফুটবল সারা বছরের উদ্রেক হোক, প্রাণ ছড়াক মাঠে ময়দানে। তবে প্রজন্মের জন্য   মাঠের অপ্রতুলতা, আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অন্তরায়। খেলোয়াড় বের করতে হলে মানসম্মত মাঠের উদ্যোগে যেতেই হবে।”

“Winners never quit and quitters never win.”—–এমন একটি মতবাদের আলোকেই যেন একজন ইমরুল হাসানের লড়ে যাওয়া। একজন সত্যিকারের চ্যাম্পিয়ন কখনই প্রতিকুলতাকে নির্দেশ করে বিদায় নিতে জানেন না। হারতে হারতে জেতার অভ্যাস তৈরি করে। বাংলাদেশের ফুটবল বাস্তবতায় বসুন্ধরা, ইমরুল হাসানের মত নেতৃত্ব দিকভ্রষ্ট বা পথহারা ফুটবলের হাল ধরেছে, এখানেই জিতে যাচ্ছে ফুটবল ও বাংলাদেশ—এমন উত্তীর্ণ রুপরেখায় ভর করে এগিয়েও যাক দেশের ফুটবল।

আহাস/ক্রী/০০৮