
ক্রীড়ালোক প্রতিবেদকঃ
ভিনিসিয়াস জুনিয়রের সাথে স্পেনের দর্শকদের বর্ণবাদী আচরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে পুরো ফুটবল বিশ্ব । ফুটবল বিশ্বের শাসক সংস্থা ‘ফিফা’ , লা লিগা কর্তৃপক্ষ , রিয়েল মাদ্রিদসহ নামীদামী সব ফুটবল তারকা দাঁড়িয়েছে ভিনিসিয়াসের পাশে । ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন ‘সিবিএফ’ ও পিছিয়ে নেই । তারাও ভিনিসিয়াসের ঘটনায় সোচ্চার । এমনকি বর্ণবাদের বিপক্ষে লড়াইয়ের অংশ হিসেবে দুটি আফ্রিকান দেশের সাথে আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচ খেলার ঘোষণা দিয়েছে ব্রাজিল ।
আগামী জুনে ব্রাজিল মাঠে নামছে গিনি আর সেনেগালের বিপক্ষে । সিবিএফ জানিয়েছে , আগামী ১৭ জুন বার্সেলোনায় ব্রাজিল মুখোমুখি হবে গিনির । আর ২০ জুন লিসবনে ব্রাজিল নামছে সেনেগালের বিপক্ষে ।
ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি এডলান্ডো রদ্রিগেজ জানিয়েছেন , ‘ ব্রাজিল বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে । ফুটবলে বর্ণবাদের কোন স্থান হবে না । ‘
ফুটবলে ফিফা’র প্রধান শ্লোগান ‘say no to racism ‘ । অর্থাৎ ফুটবলে বর্ণবাদের কোন স্থান নেই । যদিও ফুটবলে বর্ণবাদ সমস্যা বরাবরই প্রকট । নইলে বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কেন বর্ণবাদী আচরণের বিপক্ষে ব্যানারে লেখা শ্লোগান নিয়ে ম্যাচ শুরু করতে হয় ।
অতীতে বহু ফুটবলার বর্ণবাদী আচরণের শিকার হয়ে খেলা ছেড়েছেন । ২০১২ সালে সার্বিয়া আর ইংল্যান্ডের যুব দলের মধ্যকার ম্যাচে ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা ।, সার্বিয়ার দর্শকরা হেনস্থা করেন ইংল্যান্ডের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের । একই বছর ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ শুরুর আগে পোল্যান্ডের মাটিতে অনুশীলনরত হল্যান্ড দলের কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়রা বর্ণবাদী-হেনস্থার শিকার হন । আবার ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে এশিয়ান খেলোয়াড়দের নানাভাবে হেনস্থা করেন দর্শকরা । ২০২১ সালেই দক্ষিণ কোরিয়ার ফুটবলার সন হিউং মিনকে লক্ষ্য করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করা বর্ণবাদী মন্তব্য নিয়ে তোলপাড় হয় । টটেনহ্যামের কৃষ্ণাঙ্গ কলম্বিয়ান ডেভিনসন সাঞ্চজকেও ছাড় দেয় নি বিরোধী দর্শকরা ।
ইটালির মাঠে বহুবার বর্ণবাদী বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন রুমেলু লুকাকু । ইন্টার মিলানে খেলা বেলজিয়ান তারকা অসহায়ভাবে কাতর মিনতি করেছেন , ‘ ফুটবলে বর্ণবাদের ঘৃণ্য আচরণ চলছে । আমি নিজেই বহুবার শিকার হয়েছি । আশা করি ফুটবলের কর্তাব্যক্তিরা এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন । ‘
২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে টাইব্রেকারে গোল করতে পারেন নি কিংসলে কোম্যান ও অরেলিয়ান চুয়ামেনি । ফ্রান্সের সমর্থকরা তাদের বিরুদ্ধে ছুঁড়ে দেন বর্ণবাদী মন্তব্য । দেশে ফিরেও তারা হেনস্থা হয়েছেন নিজ দেশের দর্শকদের কাছে । কারণ একটাই ‘তাদের গায়ের রঙ’ ।
জার্মানির সাবেক ফুটবলার মেসুত অজিল আন্তর্জাতিক ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছেন । কারণ ? বর্ণবাদী আচরণ । অজিল মুলত তুর্কি অভিবাসী পরিবারের সন্তান । তাঁর নিজের জন্ম জার্মানিতে । ২০১৮ সালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সাথে ছবি তোলার পর জার্মানিতে তীব্র সমালোচনা হন তিনি । তাঁকে দেয়া হয়েছে প্রাণনাশের হুমকি । এমনকি , ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের কারণে তাঁকে দায়ী করা হয় । অজিল বলেছিলেন , ‘ আমরা যখন জিতি তখন আমি জার্মান, কিন্তু যখন হেরে যাই তখন একজন বিদেশি!’
২০২১ সালের জুলাইয়ে টোকিও অলিম্পিকের প্রস্তুতি ম্যাচে জার্মানির ডিফেন্ডার জর্ডান তোরুনারিঘা বর্ণবাদের শিকার হন । হন্ডুরাসের বিপক্ষে পুরো ম্যাচ না খেলেই প্রতিবাদে মাঠ ছাড়ে জার্মানি । ফুটবলে বর্ণবাদী হিংসাত্মক ঘটনার বিবরণ আসলে শেষ করা যাবে না । সম্প্রতি রিয়েল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ভিনিসিয়াস জুনিয়রকে নিয়ে চলছে তোলপাড় । তিনিও প্রতিপক্ষ সমর্থকদের বর্ণবাদী হিংসার শিকার ।
স্প্যানিশ লা লিগায় সম্প্রতি ভ্যালেন্সিয়ার কাছে ০-১ গোলে হেরেছে রিয়েল মাদ্রিদ । ভ্যালেন্সিয়ার মাঠে অনুষ্ঠিত ম্যাচে মেজাজ হারিয়ে লাল কার্ড দেখেছেন ভিনি । মেজাজ তিনি হারিয়েছেন দর্শকদের বর্ণবাদী উস্কানিতে । বহুদিন ধরেই লা লিগায় বর্ণবাদের শিকার ভিনি । বার্সেলোনা , এথলেটিকো মাদ্রিদ , মায়োর্কা, রিয়াল ভায়াদোলিদের মাঠে তিনি শিকার হয়েছেন বর্ণবাদী দর্শকদের বিরুপ আচরণের ।
ভ্যালেন্সিয়ার দর্শকরা শুরু থেকেই উত্যক্ত করছিল ভিনিকে । একবার খেলা ছেড়ে বেশ কিছুক্ষণ গোলবারের পেছনে গিয়ে সমর্থকদের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ছিলেন তিনি । অবস্থা এতটা খারাপ পর্যায়ে চলে যায় যে ম্যাচ রেফারি রিকার্ডে ডি বারগোস বেনগয়েস্কা স্টেডিয়ামের কর্মকর্তাদের কাছে অনুরোধ করেন মাইকে ঘোষণা দিয়ে দর্শকদের শান্ত করতে । কিন্তু কাজ হয় নি । ম্যাচের এক পর্যায়ে অশ্রু ঝরেছে ভিনির চোখ দিয়ে ।
ম্যাচের পর ভিনিসিয়াস বলেছেন , ‘ আমার সাথে শুরু থেকে বিরুপ আচরণ করা হচ্ছে । লা লিগা কর্তৃপক্ষ সব জেনেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না । স্পেন বর্ণবাদের প্রধান আখড়ায় পরিণত হয়েছে । ‘
ভিনির বিপক্ষে লাগাতার বর্ণবাদী আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে রিয়েল মাদ্রিদ । ভ্যালেন্সিয়া কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভিনিসিয়াস জুনিয়রের সঙ্গে বর্ণবাদী অঙ্গভঙ্গি করা এক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিকে মেসটাল্লা স্টেডিয়াম থেকে আজীবন নিষিদ্ধ করা হবে।
তবে লা লিগা সভাপতি হাভিয়ের তেবাস ভিনিসিয়াসের দিকেই উল্টো তোপ দাগেন। তার মতে, দর্শকদের এমন আচরণের পেছনে ভিনিসিয়াসেরও দায় আছে। তিনি বলেছিলেন, ‘লা লিগার দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে তাকাও ভিনিসিয়াস। বর্ণবাদ নিয়ে লা লিগার করণীয় বিষয়ে আপনার কাছে আমাদের ব্যাখ্যা করা উচিত, সেহেতু আমরা সেই চেষ্টা করেছি। কিন্তু এর আগে দুই দফা আপনি দিনক্ষণ দিয়েও উপস্থিত হননি। সমালোচনা এবং লা লিগাকে অপমান করার আগে যথাযথভাবে নিজেকে জানাতে হবে। অন্যের দ্বারা পরিচালিত হবেন না।’
তেবাসের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ফুটবল বিশ্বে । অনেকেই তেবাসকেই বর্ণবাদী বলে অভিহিত করেছেন । শেষ পর্যন্ত লা লিগা কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে স্পেন থেকে বর্ণবাদী আচরণ সমুলে উৎপাটন করার । তারা জানিয়েছে , ভিডিও আর ছবি দেখে দোষীদের খুঁজে বের করা হবে ।
কিলিয়ান এমবাপ্পে আর নেইমারের মতো ফুটবলাররা সংহতি জানিয়েছেন ভিনির পক্ষে । ফিফা’র সভাপতি জিওভান্নি ইনফান্তিনো জানিয়েছেন , ‘ বর্ণবাদ বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে । আর কোন বর্ণবাদী ঘটনা বরদাস্ত করা হবে না । ‘
আহাস/ক্রী/০০৫