
আহসান হাবীব সুমন/ক্রীড়ালোকঃ
ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে দুর্দান্ত সাফল্য পাচ্ছেন পেপে গার্দিওলা । ম্যান সিটিকে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ফুটবলে এনে দিচ্ছেন একের পর এক শিরোপা । অর্ধ-যুগ ধরে ইংল্যান্ডের আর কোন ক্লাব চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারছে না সিটিজেনদের সামনে । ঠিক যেমন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড প্রিমিয়ার লিগ শুরুর জামানা থেকে ছড়ি ঘুরিয়েছে অন্যদের উপর । পেপে গার্দিওলার ম্যান সিটিও মনে করিয়ে দিচ্ছে তাদেরই নগর প্রতিপক্ষের সোনালী অতীতের দাপট ।
অনেকেই প্রশ্ন ছুঁড়তে শুরু করেছেন , গার্দিওলা কি স্যার ফার্গুসনের সাফল্য ছাড়িয়ে শ্রেষ্ঠত্বের পথে ? কিংবা ইতোমধ্যে নিজেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন গার্দিওলা ? উত্তর হচ্ছে , অন্তত ইংল্যান্ডে পাওয়া সাফলের বিবেচনায় গার্দিওলা ছাড়াতে পারেন নি স্যার ফার্গুসনকে । আবার সার্বিক ক্যারিয়ার বিবেচনায় গার্দিওলা সাফল্যের প্রশ্নে বিশ্বের অন্যতম সেরা কোচ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন , এটাও মিথ্যা নয় ।
স্যার ফার্গুসনের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে নিজ দেশের স্টারলিংস ক্লাবের হয়ে । ১৯৮৫-৮৬ মৌসুম ছিলেন স্কটল্যান্ড জাতীয় দলের কোচ । পরবর্তীতে ২০১৩ সাল পর্যন্ত কোচিং ক্যারিয়ারের পুরো সময় ম্যান ইউর ডাগ আউটে কাটিয়েছেন । নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন কিংবদন্তী হিসেবে ।
ফার্গুসনের অধীনে ম্যান ইউ জিতেছে রেকর্ড ১৩টি প্রিমিয়ার লিগ । ফার্গুসনের ঝুলিতে আছে পাঁচটি এফএ কাপ , চারটি লিগ কাপ , ১০টি ইংলিশ কমুনিটি শিল্ড । ফার্গুসনের অধীনে দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতেছে রেড ডেভিলরা । ফাইনালে খেলেছে আরো দুইবার । এছাড়া ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ , উয়েফা সুপার কাপ আর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ এসেছে একটি করে । ম্যান ইউর হয়ে ফার্গির শিরোপা সংখ্যা ৩৮টি ।
ম্যান ইউর হয়ে সম্ভাব্য সব শিরোপা নিজের দখলে নিয়েছেন স্যার ফার্গুসন । সবাই ম্যান ইউর হয়ে পাওয়া বিশাল সফলতার কারণেই ফার্গুসনকে স্মরণ করে । কিন্তু ফার্গুসন নিজ দেশেও কম সফল ছিলেন না । স্কটল্যান্ডের সেইন্ট ম্যারিয়েনকে ১৯৭৬-৭৭ মৌসুমে তিনি এনে দিয়েছেন লিগ শিরোপা ।
১৯৭৮-৮৬ পর্যন্ত দীর্ঘ আট মৌসুম ফার্গুসন কাটিয়েছেন স্কটিশ অ্যাবারডিনে । সেখানেও দেখিয়েছেন আধিপত্য । অ্যাবারডিনকে জিতিয়েছেন তিনটি স্কটিশ প্রিমিয়ার লিগ । জিতেছেন আরও চারটি স্কটিশ কাপ আর সুপার কাপ ।
অ্যাবারডিনে শুধু ঘরোয়া না , পেয়েছেন ইউরোপিয়ান সাফল্য । ১৯৮২-৮৩ মৌসুমে অ্যাবারডিন ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপের ফাইনালে রিয়েল মাদ্রিদকে হারিয়ে জিতে নেয় শিরোপা । একই বছর ইউরোপিয়ান সুপার কাপেও ফার্গুসনের দল হারায় জার্মানির হামবুর্গকে । অর্থাৎ ম্যান ইউতে যোগদানের আগেই ফার্গুসন পেয়ে গেছেন ইউরোপ জয়ের স্বাদ ।
ফার্গুসন রেকর্ড ১১বার প্রিমিয়ার লিগের বর্ষসেরা নির্বাচিত হয়েছেন । হ্যাঁ , ফার্গুসন কখনও ফিফা বা ব্যালন ডি অর বর্ষসেরা কোচ নির্বাচিত হন নি । হবেন কি করে ? পুরস্কারের প্রচলন হয় ২০১০ সাল থেকে । যখন ফার্গুসনের ক্যারিয়ার প্রায় শেষের দিকে । তবে ১৯৯৮-৯৯ মৌসুমে ইউরোপের সেরা কোচের সম্মাননা পেয়েছেন । জায়গা করে নিয়েছেন ফ্রান্স সাময়িকীর সর্বকালের সেরা কোচের তালিকার দ্বিতীয় স্থানে । যেখানে হল্যান্ডের রিনাস মিচেল পেয়েছেন শীর্ষস্থান ।
এবার আসা যাক পেপে গার্দিওলার প্রসঙ্গে । স্পেনের সাবেক ফুটবলার গার্দিওলা কোচ হিসেবেও তুমুল সফল । তাঁরও জয় করার মতো কিছু বাকী নেই । তাঁর কোচিং ক্যারিয়ার শুরু বার্সেলোনা ‘বি’ দলের হয়ে । ২০০৮-০৯ মৌসুম থেকে দায়িত্ব পান বার্সার সিনিয়র দলের । প্রথম মৌসুমেও বার্সাকে পাঁচটি শিরোপা জিতিয়ে গড়েন নতুন ইতিহাস । বার্সা জিতে নেয় স্প্যানিশ লা লিগা , কোপা ডেল রে , স্প্যানিশ সুপার কাপ , উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর উয়েফা সুপার কাপ । অর্থাৎ এক মৌসুমে শিরোপার চক্র পূরণ করেন গার্দিওলা । ২০১০-১১ মৌসুমেও গার্দির বার্সা পেয়েছে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের স্বাদ । গার্দিওয়ালার সময়েই বার্সা পরিণত হয় বিশ্বের সেরা ক্লাবে । জয় করে মোট ১৪টি শিরোপা ।
বায়ার্নের কোচ হিসেবেও সফলতা পেয়েছেন গার্দিওলা । বাভারিয়ানদের জিতিয়েছেন টানা তিনটি বুন্দেস লিগা । এনে দিয়েছেন দুটি জার্মান কাপ । একটি করে উয়েফা সুপার কাপ আর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ ।
ম্যান সিটিকে ছয় মৌসুমে জিতিয়েছেন পাঁচটি প্রিমিয়ার লিগ । চারটি লিগ কাপ , দুটি কমুনিটি শিল্ড আর একটি এফএ কাপ । সিটিজেনদের উঠিয়েছেন ২০২০-২১ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে । কিন্তু চেলসির কাছে হেরে তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয় । চলতি মৌসুমেও ইউরোপের সেরা আসরের ফাইনালে উঠে গেছে ম্যান সিটি । শিরোপা লড়াইয়ে তাদের প্রতিপক্ষ ইটালির ইন্টার মিলান । আশা করা হচ্ছে , দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় গার্দিওলা পূরণ করবেন বার্সার পর ম্যান সিটিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতানোর স্বপ্ন ।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগে সবচেয়ে বেশী চারবার শিরোপা জয়ের রেকর্ড আছে কার্লো আঞ্চেলত্তির । তিনবার করে শিরোপা জিতেছেন জিনেদিন জিদান আর বব পেইসলির । চলতি মৌসুমে জিতলে জিদান আর পেইসলির কাতারে উঠে আসবেন গার্দিওলা ।
গার্দিওলা তিনবার জিতেছেন ইংল্যান্ডের বর্ষসেরা ম্যানেজারের সম্মান । চারবার হয়েছেন স্পেনের বর্ষসেরা । ২০১১ সালে জিতেছেন ফিফা বর্ষসেরা কোচের সম্মান । আর ব্যালনের সর্বকালের সেরা কোচের তালিকায় তাঁর স্থান পঞ্চম । ম্যান সিটিকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জেতাতে পারলে নিজের অবস্থান আরও উঁচুতে নিয়ে আসবেন গার্দিওলা , কোন সন্দেহ নেই ।
সার্বিক সাফল্যে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের চেয়ে খুব বেশী পিছিয়ে নেই গার্দিওলা । গার্দিওলার ভক্তরা বরং এগিয়ে রাখে নিজের পছন্দের কোচকে । যুক্তি ? ফার্গুসনের সাথে মুখোমুখি দুইটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল লড়াইয়ে বার্সার হয়ে জিতেছেন গার্দিওলা । যা ফার্গুসন পারেন নি । আবার ফার্গুসনের ভক্তদের যুক্তি , গার্দিওলা সব সময়েই সেরা দলের হয়ে কাজ করেছেন । তাঁর বার্সেলোনা , বায়ার্ন কিংবা ম্যান সিটি তারকাখচিত দল । ফার্গুসন বরং তারকা তৈরি করেছেন । ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো , রায়ান গিগস কিংবা রয় কিনরা তৈরি হয়েছে ফার্গুসনের হাত ধরে । তাই স্কটিশ ভদ্রলোক শুধু কোচ হিসেবেই সেরা না । তিনি খেলোয়াড় তৈরির কারিগর । ফুটবল দুনিয়ার ‘পাকা জহুরী’ ।
আহাস/ক্রী/০০৩