Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

ইস্পাত কঠিন মানসিকতার ফুটবলার আলী আশফাক

আহসান হাবীব সুমন/ক্রীড়ালোকঃ

২০১৩ সালে ফুটবল বিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন আলি আশফাক । ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফুটবল হিস্টোরি অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিক্স (আইএফএফএইচএস) প্রতি বছরের মতো বিশ্ব ফুটবলের সেরা গোলদাতা নির্বাচন করেছিল । যেখানে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন আশফাক । 

‘আইএফএফএইচএস’ বছরের সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে বিবেচনায় নেয় জাতীয় দল আর মহাদেশীয় ক্লাব পর্যায়ের গোল । আলি আশফাক ২০১৩ সালে করেছিলেন ২৩ গোল । যার মধ্যে মালদ্বীপের হয়ে আন্তর্জাতিক ম্যাচে তাঁর গোলের সংখ্যা ছিল ১৪টি । আর নিজ দেশের নিউ রেডিয়েন্ট ক্লাবের হয়ে এএফসি পর্যায়ে করেছিলেন ৯টি গোল । পর্তুগীজ মহাতারকা রোনালদোর গোলসংখ্যা ছিল ২৫টি । তিনি রিয়েল মাদ্রিদ ক্লাবের হয়ে উয়েফা আয়োজিত আসরে ১৬টি আর পর্তুগালের হয়ে করেছিলেন ৯ গোল । ‘আইএফএফএইচএস’ এর পুরস্কারের আশফাক পেছনে ফেলেছিলেন লিওনেল মেসি আর  জ্লাতান  ইব্রাহিমোভিচের মতো বিখ্যাত ফুটবলারদের । 

২০১৩ সালের সাফ টুর্নামেন্টেই আশফাক করেন ১০ গোল । যা দক্ষিণ এশিয়ার সেরা ফুটবল টুর্নামেন্টে এক মৌসুমের রেকর্ড । সাফের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৩ গোলের মালিক আশফাক । ১৮ গোল করে
দ্বিতীয় অবস্থানে আছেন ভারতের সুনীল ছেত্রী । আশফাকের মালদ্বীপ দুইবার জিতেছে সাফ ফুটবলের শিরোপা ।

একটা সময় মালদ্বীপ ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দুর্বলতম দল । বাংলাদেশ , ভারত তো বটেই ; নেপাল আর শ্রীলংকার কাছেও তারা হেরেছে । কিন্তু নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে দ্বীপ দেশটির ফুটবল । যা পূর্ণতা পায় আশফাকদের আগমনে । মালদ্বীপ এখন দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিষ্ঠিত শক্তি । আর সেটা সম্ভব হয়েছে আলী আশফাকের মতো একজন ফুটবলার পাওয়ায় । তিনিই প্রথম মালদ্বীপের খেলোয়াড় যিনি বিদেশী ক্লাবে খেলেছেন এবং শিরোপা জয় করেছেন ।

২০০১ সালে আশফাকের ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু নিজে দেশের ভ্যালেন্সিয়ার হয়ে । ২০০৭ সাল থেকে খেলেছেন ব্রুনাইয়ের মুদা মাখোতা ফুটবল ক্লাবে । এছাড়া খেলেছেন মালয়েশিয়ার পুলিশ ক্লাবে । ৩৭ বছর বয়সী আলী আশফাক এখন খেলছেন নিজ দেশের ক্লাব ইগলসে ।

ক্লাব ক্যারিয়ারে আলী আশফাকের গোলের সংখ্যা ৪৪২ ম্যাচে ৩৯৮টি । এছাড়া নিজ দেশের হয়ে ৯৭ আন্তর্জাতিক ম্যাচে করেছেন ৫৮ গোল । যা নিজ দেশের সর্বোচ্চ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কিংবদন্তি চা বুম-কুনের সমান । বর্তমানে এশিয়ার সর্বকালের সেরা আন্তর্জাতিক গোলদাতা তালিকার দশম স্থানে আছেন আশফাক । শীর্ষে রয়েছেন ইরানের সাবেক গ্রেট আলী দাইয়ী । আন্তর্জাতিক গোলের সংখ্যায় তিনি এখনও এগিয়ে আছেন হ্যারি কেইন আর অলিভার জিরুদদের চেয়ে ।

২০১৪ সালে মালয়েশিয়ান লিগের সেরা বিদেশী ফুটবলার নির্বাচিত হন আশফাক । ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে এশিয়ার সেরা ফুটবলারের তালিকায় সেরা দশে জায়গা করে নেন । সাতবার তিনি জিতেছেন মালদ্বীপের সেরা গোলদাতার পুরস্কার । পাঁচবার নির্বাচিত হয়েছেন মালদ্বীপের বর্ষসেরা । একমাত্র মালদ্বীপ ফুটবলার হিসেবে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা গোলদাতা আর সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন । করেছেন মালদ্বীপের পক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক হ্যাট্রিক ।  

২০১৪ সালে মালয়েশিয়ার পুলিশ দলকে লিগ শিরোপা জেতাতে রাখেন প্রধান ভুমিকা । আসরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ গোল করে সবাইকে তাক লাগান আলী আশফাক । লাইবেরিয়ার এডওয়ার্ড উইলসন ১৯ গোল করে ছিলেন শীর্ষে । তিনি পাল্লা দিয়েছেন ব্রাজিল , আইভরি কোস্ট , দক্ষিণ কোরিয়া , নাইজেরিয়া আর স্পেনের ফুটবলারদের সাথে । গোটা আসরে একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে করেন দুটি হ্যাট্রিক ।

আশফাক শুধু মালদ্বীপের ফুটবলকে গর্বিত করেন নি , পরিচিতি দিয়েছেন দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলকে । ২০১৩ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পর ‘আইএফএফএইচএস’ এর তালিকায় আশফাকের জায়গা করে নেয়া বিরাট ঘটনা । অথচ আশফাক নিজে কখনও ফুটবলার হতে চান নি । তাঁর ফুটবলে আসাটাই আকস্মিক । স্কুল ফুটবলে তাঁর ভাই আশফান খেলতেন । একই স্কুলে পড়াশুনা করতেন আশফাক । একদিন ভাইয়ের দলে খেলোয়াড় কম পড়ে যাওয়ায় ডাকা হয় তাঁকে । তখন তাঁর মাত্র ৯ বছর বয়স ।

আশফাক এক সাক্ষাৎকারে ‘ফিফা ডট কম’কে বলেছিলেন , ‘ আমার কখনও ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা ছিল না । আমি কখনও প্রাতিষ্ঠানিক ফুটবল শিক্ষা নেই নি । কিংবা কোন একাডেমীতেও যাই নি । হ্যাঁ , এলাকার বন্ধুদের সাথে ফুটবল নিয়ে ছুটাছুটি করতাম । কিন্তু ফুটবলার হব এমন লক্ষ্য কখনও ছিল না । ‘

কিন্তু প্রতিভা তো লুকিয়ে রাখা যায় না । তাই মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁকে খুঁজে নেয় ভ্যালেন্সিয়া । সেই ক্লাবের হয়েই তাঁর আকস্মিক অভিষেক । মালদ্বীপের ঘরোয়া কাপ টুর্নামেন্টে তিন ম্যাচ নিষেধাজ্ঞায় ছিলেন প্রভাবশালী ফুটবলার আলী উমর । তাঁর জায়গাতেই সুযোগ পেয়ে যান আশফাক । আলী উমর পরবর্তীতে মালদ্বীপ ফুটবল ফেডারেশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ।

আলী আশফাককে একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার বলা যায় । তিনি শুধু ফরোয়ার্ড পজিশন না , খেলেছেন উইঙ্গার হিসেবে । প্রয়োজনে মাঝমাঠে পালন করেছেন দায়িত্ব । সাত  নাম্বার জার্সি গায়ে চাপিয়ে মাঠ মাতিয়েছেন  । তাঁর গতি , ড্রিবলিং আর গোল করার অসাধারণ ক্ষমতা – মাঠে অন্যদের চাইতে আলাদা করে সহজেই । যে কারণে বিদেশী যে কোন প্রতিপক্ষ মালদ্বীপের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে আলাদা ছক কষে নেয় আশফাককে আটকাবার জন্য । দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলারদের দুর্বলতা রয়েছে ফ্রি-কিকে । কিন্তু আশফাক নিজের আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছেন ফ্রি-কিক স্পেশালিস্ট হিসেবে । 

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সুনীল ছেত্রী আন্তর্জাতিক গোলে এগিয়ে আছেন আশফাকের চেয়ে । তাঁর গোলের সংখ্যা ১৩৩ ম্যাচে ৮৬টি । ভারতের একজন খেলোয়াড় হিসেবে অসাধারণ , সন্দেহ নেই । কিন্তু ক্যারিয়ার জুড়ে গোলের সংখ্যায় ছেত্রীর চেয়ে এগিয়ে আশফাক । আন্তর্জাতিক আর ক্লাব মিলিয়ে ছেত্রীর গোল ৩০২টি । যেখানে আশফাকের ক্লাব ফুটবলেই গোলের সংখ্যা ৩৯৮টি ।

আশফাক নেতা হিসেবেও অন্যদের চেয়ে এগিয়ে । দীর্ঘ সময় পালন করেছেন জাতীয় দলের অধিনায়কত্ব । আশফাকের মাঠে থাকা মানেই দল উজ্জীবিত থাকা । সেটা ক্লাব ফুটবল হোক আর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা । হারার মানসিকতা থেকে অনেক দূরে আশফাক ।  তাঁকে মালদ্বীপে ডাকা হয় ‘ধিভেহি’ নামে । ইংরেজি তর্জমায় দাঁড়ায় Man of Steel । খেলার মাঠে তাঁর মানসিকতা ইস্পাতের মতই কঠিন । যে কারণে এই নাম ।

আহাস/ক্রী/০০৫