Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

সার্বিয়া দলে ভয়ংকর ড্রাগন

আহসান হাবীব সুমনঃ

সার্বিয়া । এক সময়ে যুগোস্লাভিয়ার অংশ দেশটি বর্তমানে পুরোপুরি স্বাধীন । ঠিক যেমনটা ক্রোয়েশিয়া । যুগোস্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রোয়েশিয়া ইতোমধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে ফুটবল শক্তি হিসেবে । সার্বিয়াও হাঁটছে সেই পথে । একজন ড্রাগন স্টয়কোভিচের তত্ত্বাবধানে দ্রুত উঠে আসা সার্বিয়ার  কাতার বিশ্বকাপে ‘চমক’ হিসেবে আবির্ভূত’ হবার সব উপাদান নিয়েই আসছে ।

সার্বিয়ার বিশ্বকাপ স্কোয়াডে আছে অ্যালেক্সান্ডার মিত্রোভিচের মতো ফরোয়ার্ড । যার ঝুলিতে ৭৬ ম্যাচে ৫০ আন্তর্জাতিক গোল । আছে ডুসান টাডিচের মতো অধিনায়ক । আছে লুকা জোভিচ , নিকোলা মিলাংকোভিচ , ফিলিপ কস্টিচ আর ডুসান ভ্লাহোভিচের মতো খেলোয়াড় । যারা বিশ্বের যে কোন বড় দলকে চমকে দেয়ার সামর্থ্য রাখে । তবে দলের নেতা অবশ্যই একজন ড্রাগন স্টয়কোভিচ । যিনি সার্বিয়ার সর্বকালের সেরা ফুটবলার । এখন দাঁড়াচ্ছেন সার্বিয়ান দলের ডাগ আউটে । স্টয়কোভিচের ক্ষুরধার ফুটবল মস্তিস্ককে পুঁজি করে দারুণ কিছু করে দেখাবার প্রত্যয়ে কাতার এসেছে সার্বিয়া ।

স্টয়কোভিচ হচ্ছেন সেই ফুটবলার , যিনি আশি আর নব্বই দশকে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডিয়াগো ম্যারাডোনাকে চোখ রাঙিয়েছেন । মধ্যমাঠের অন্যতম সেরা কারিগর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজেকে । চিনিয়েছেন আলাদাভাবে । স্টয়কোভিচ ১৯৯০ সালে যুগোস্লোভিয়ার হয়ে বিশ্বকাপ খেলেছেন  । ১৯৯৮ সালে ‘যুগোস্লোভিয়া ফেডারেশন’ নামের দলে অধিনায়ক ছিলেন । যদিও সেই সময় যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গেছে । সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’ নাম নিয়ে কিছুকাল টিকে ছিল । কিন্তু  ২০০৬ সালের ৫ই জুন যুগোস্লাভিয়া ভেঙ্গে মন্টেনিগ্রো ও সার্বিয়া স্বাধীন হয়ে যায় এবং তার ফলে ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায় যুগোস্লাভিয়া নামের দেশটি।পরবর্তীতে মন্টেনিগ্রোও সার্বিয়া থেকে ২০০৮সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বাধীনতা ঘোষণা করে । 

যাই হোক , এসব রাজনীতির বিষয় । আমরা কথা বলছিলাম স্টয়কোভিচকে । যুগোস্লাভিয়ার হয়ে খেলা স্টয়কোভিচ একজন সার্বিয়ান । যার ক্লাব ক্যারিয়ার শুরু ১৯৮১ সালে নিজ দেশের রেডনিকি ক্লাবের হয়ে । ১৯৮৬-১৯৯০ পর্যন্ত খেলেছেন সার্বিয়ার রেড স্টার বেলগ্রেডে । তাঁর সময়ে বেলগ্রেড খেলেছে উয়েফা কাপের সেমি ফাইনালে । দলের হয়ে ১২০ ম্যাচে ৫৪ গোল করেছিলেন তিনি ।

আর তারপরেই পাড়ি জমান ফ্রান্সের অলিম্পিক মার্শেইয়ে ।যদিও মার্শেইয়ে প্রথম মৌসুমের শুরুটা ভাল যায় নি তাঁর । হাঁটুর অপারেশনের কারণে বেশীরভাগ সময় মাঠের বাইরে কাটাতে হয় তাঁকে । ১৯৯০-৯৪ পর্যন্ত মার্শেইতে ছিল তারকার মেলা । খেলেছেন জ্যা পিয়েরে পাপিন , এরিক কাঁতোয়া , দিদিয়ের দেশাম্প , জ্যা টিগানা আর আবেদি পেলের মতো মহাতারকা । আর সেই স্কোয়াডের মধ্যমনি ছিলেন ড্রাগন স্টয়কোভিচ । সেই সময়ে মার্শেইকে ‘গ্যালাক্টিকোস’ বললেও ভুল হবে না । ১৯৯২-৯২ মৌসুমে মার্শেই জিতেছে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ । ১৯৯৪-২০০১ পর্যন্ত জাপানের নাগোয়া গ্রাম্পাস ক্লাবে খেলে অবসরে যান তিনি ।

ক্লাব ক্যারিয়ারে ৪২২ লীগ ম্যাচে স্টয়কোভিচের গোলের সংখ্যা ১২৫টি । এটি শুধু লীগের হিসেব । এছাড়া জাতীয় দলের ৮৪ ম্যাচে ১৫ গোল আছে তাঁর । ১৯৮৯ আর ১৯৮৯ সালে সালে যুগোস্লোভিয়ার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন ।

১৯৯০ সালের বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা আর যুগোস্লোভিয়ার লড়াই সেই সময়ের দর্শকদের মনে এখনও উজ্জ্বল । ম্যাচটিতে মুখোমুখি হয়েছিলেন ম্যারাডোনা আর স্টয়কোভিচ । হাড্ডাহাড্ডি ১২০ মিনিট লড়াই শেষ হয় সমতায় । টাইব্রেকারে ম্যাচটি গোলরক্ষক গয়কোচিয়ার অসধারন নৈপুণ্যে আর্জেন্টিনা জিতে নেয় । মজার ব্যাপার হচ্ছে , দুই দেশের দুই দিকপাল ম্যারাডোনা আর স্টয়কোভিচ নষ্ট করেন পেনাল্টির সুযোগ । তবে তিনি জায়গা করে নেন ইটালির মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপের অল-স্টার দলে ।

জাপানের ফুটবল জনপ্রিয়তায় স্টয়কোভিচের অবদান অসামান্য । জে-লিগ শুরুর দিকে তিনি টানা খেলেছেন জাপানে । সেই সময়ে জাপানে সুমো আর বেসবলের মতো খেলা ফুটবলের চেয়ে বেশী জনপ্রিয় । কিন্তু জিকো আর স্টয়কোভিচের মতো বিশ্বতারকাদের উপস্থিতিতে জাপানিজদের আগ্রহ বাড়ে ফুটবলের প্রতি । যে কারণে জাপানের রাজকীয় ‘order of rising sun’ পুরস্কারে ভূষিত কড়া হয় তাঁকে ।

ফুটবলার হিসেবে সাফল্য পাওয়া জাপানের গ্রাম্পাস দলের হয়েই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন স্টয়কোভিচ , ২০০৮ সালে । কাজ করেছেন চীনের গুয়াংজু ক্লাবের সাথে । ২০২১ সালের মার্চে পেয়েছেন বর্তমান সার্বিয়া স্কোয়াডের দায়িত্ব । তাঁর তত্ত্বাবধানে সার্বিয়া সরাসরি পেরিয়েছে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের বাঁধা । পেছনে ফেলেছে গ্রুপ পর্বে ফেভারিট পর্তুগালকেও । পূর্ণ স্বাধীন সার্বিয়া ২০১০ আর ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে খেললেও গ্রুপ পর্বের বাঁধা পেরুতে পারেনি । কিন্তু এবার তাদের সামনে দারুণ সুযোগ অসাধারণ কিছু করার ।

সার্বিয়ার গ্রুপে আছে ব্রাজিল , সুইজারল্যান্ড আর ক্যামেরুন । ব্রাজিল আর সুইজারল্যান্ড অবশ্যই শক্তিশালী দল । কিন্তু সার্বিয়ার রয়েছে একটি শক্তিশালী মধ্যমাঠ আর আক্রমণভাগ । তাদের খেলোয়াড়দের দৈহিক গড়ন আর বাতাসে ভেসে আসা বল দখলে সক্ষমতা যে কোন দলকে বিপদে ফেলতে পারে । ডিফেন্সেও একই কথা প্রযোজ্য । সেপ্টেম্বরে সুইডেনকে ৪-১ আর নরওয়েকে ২-০ গোলে হারিয়ে বিশ্বকাপের জন্য নিজেদের প্রস্তুতি জানা দিয়েছে সার্বিয়া ।

স্টয়কোভিচ দলকে খেলান ৩-৪-২-১ ফর্মেশনে । যেখানে একজন্মাত্র ফরোয়ার্ড হিসেবে মিত্রোভিচ খেলেন । যদিও ফুলহ্যামে খেলা এই তারকা ইনজুরিতে আছেন । কিন্তু সার্বিয়ান কোচ বলেছেন , ‘এক পা নিয়ে হলেও মিত্রোভিচকে খেলাবেন তিনি!’ । বোঝাই যায় , নিজের দল আর লক্ষ্য নিয়ে কতটা সিরিয়াস তিনি । এছাড়া , মধ্যমাঠে একজন বাড়তি মিডফিল্ডার লুকিচ আর মিলাংকোভিচ-সেভিচের সাথে জুড়ে দেন । ফলস নাইন কিংবা আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে ব্যবহার করেন টাডিচকে ।

সব মিলিয়ে মধ্যমাঠের খেলোয়াড় হিসেবে মাঝমাঠের দখল নিতেই সব চিন্তাভাবনা স্টয়কোভিচের । আর ফুটবলে মধ্যমাঠের দখল সাফল্যের জন্য কতটা গুরুত্ব রাখে , সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না । এই নিয়ে সার্বিয়ান কোচের বক্তব্য , ‘ আমি সেই কোচ যে দলকে আকর্ষণীয় ফুটবল খেলতে উৎসাহিত করে । সাথে ফলাফল এনে দেয়া জরুরী । ‘

স্টয়কোভিচের অধীনে ২০ ম্যাচে পাওয়া সার্বিয়ার ১৩ জয় আর ৪ ড্র প্রমাণ করে , তারা সঠিক পথেই আছে ।

আহাস/ক্রী/০০২