আহসান হাবীব সুমনঃ
ছবির দেশ , কবিতার দেশ , ফ্যাশনের দেশ , সুগন্ধির দেশ – ফ্রান্স । তারা আবার ফুটবলেরও পরাশক্তি । বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলার বিশ্ব-আসরে যাদের রয়েছে দুইটি শিরোপা । সর্বশেষ ২০১৮ সালেও ফুটবল বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেছিল ফরাসীরা । আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বরে কাতারে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপ ফুটবলে ফরাসীরা যাচ্ছে শিরোপা ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে । ইটালি আর ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় কোন দেশ হিসেবে পারবে কি ফ্রান্স টানা দ্বিতীয়বার বিশ্বকাপ ফুটবলের শিরোপা জিততে ? নাকি সাম্প্রতিক সময়ে চ্যাম্পিয়ন দলের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে বিদায় নেবে প্রথম রাউন্ড থেকে ?
ফ্রান্সের ফুটবলের সূচনাপর্বঃ
১৯০০ সালের অলিম্পিকে ফ্রান্স ফুটবল দল অংশ নেয় ‘ইউনিয়ন অফ ফ্রেঞ্চ এথলেটিক সোসাইটি’ নামে । আর তাদের প্রথম অফিসিয়াল আন্তর্জাতিক ম্যাচ ১৯০৪ সালের ১ মে বেলজিয়ামের বিপক্ষে । বেলজিয়ামের মাঠে অনুষ্ঠিত ম্যাচটি ছিল ৩-৩ গোলে ড্র । খেলার ১২ মিনিটে লুইস মেসনিয়ের ফ্রান্সের পক্ষে প্রথম আন্তর্জাতিক গোলটি করেন ।
১৯০৫ সালে ফ্রান্স নিজেদের মাটিতে প্রথমবার খেলতে নামে । ১২ ফেব্রুয়ারি পার্ক ডি প্রিন্সেসের সেই ম্যাচে ১-০ গোলে জয় পায় ফরাসীরা । যা আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফ্রান্সের প্রথম জয় । ফ্রান্সের হয়ে জয়সুচক গোলটি করেছিলেন গ্যাস্টন সাইপ্রেস ।
বিশ্বকাপ ফুটবলে ফ্রান্সঃ
১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ফিফার সূচনাকালীন সদস্য ফ্রান্স । অংশ নেয় ১৯৩০ সালে উরুগুয়ের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপে । ১৩ জুলাই মন্টেভিডিওতে ফ্রান্সের মুখোমুখি হয় মেক্সিকো । এটা ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের অভিষেক ম্যাচ । ম্যাচটি ফ্রান্স জিতে নেয় ৪-১ গোলে ।খেলার ১৯ মিনিটে প্রথম গোলের দেখা পান লুসিয়েন লরেন্ট । তিনি শুধু ফ্রান্সের নন , বনে যান বিশ্বকাপ ইতিহাসের প্রথম গোলদাতা । যদিও পরবর্তী দুই ম্যাচে আর্জেন্টিনা আর চিলির কাছে হেরে গ্রুপ পর্বেই শেষ হয় ফ্রান্সের প্রথম বিশ্বকাপ ।
বিশ্বকাপ ফুটবলে অন্যতম সফল দল ফ্রান্স । অংশ নিয়েছে ১৫টি আসরের মুলপর্বে । মোট ৬৬ বিশ্বকাপ ম্যাচে জয় পেয়েছে ৩৪টি । ড্র ১৩টি (টাইব্রেকারে যাওয়া ম্যাচ ড্র হিসেবে ধরা হয়) আর পরাজয় ১৯ ম্যাচে । বিশ্বকাপে ফ্রান্সের খেলোয়াড়রা গোল করেছে ১২০টি আর হজম করেছে ৭৭টি ।
বিশ্বকাপ ফুটবলে ১৯৯৮ আর ২০১৮ সালে শিরোপা জিতেছে ফ্রান্স । ২০০৬ সালে ফাইনালে উঠে হেরেছে ইটালির কাছে । এছাড়া আরও তিনবার তারা বিদায় নিয়েছে সেমিফাইনাল থেকে ।
ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ সবচেয়ে বেশী ১৭ ম্যাচ খেলেছেন গোলরক্ষক ফ্যাবিয়েন বার্থেজ । ১৯৯৮, ২০০২ আর ২০০৬ সালের বিশ্বকাপে তিনি ফ্রান্সের এক নাম্বার গোলরক্ষক হিসেবে খেলেছেন । ১৯৯৮-২০১০ পর্যন্ত সমান ১৭টি বিশ্বকাপ ম্যাচ খেলেছেন থিয়েরি অরি । তিনিই ফ্রান্সের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন চারটি বিশ্বকাপ ।
ফ্রান্সের হয়ে সর্বাধিক ১৩টি বিশ্বকাপ গোল জ্যা ফন্টেইনের । সেটাও ১৯৫৮ সালের একটি বিশ্বকাপ খেলেই । যা এখনও কোন বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত গোলের রেকর্ড ।
বিশ্বকাপ ফুটবলে ফ্রান্সের স্মরণীয় ঘটনাঃ
১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে ফ্রান্স ছিল অন্যতম ফেভারিট । মিশেল প্লাটিনি আর জ্যা টিগানাদের ফ্রান্সের ফুটবলে যেন ছিল নিপুন শিল্পীর তুলির আঁচড় । মন ভরিয়ে দেয়ার মতো খেলা উপহার দিয়েও ফ্রান্স অবশ্য সেমিতে হেরে যায় জার্মানির কাছে । শেষ পর্যন্ত বেলজিয়ামকে হারিয়ে ফরাসীরা পায় তৃতীয় স্থান । শিরোপা না পেলেও ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপকে বলা যায় ফ্রান্স ফুটবলের উত্থান-পর্ব । তখন পর্যন্ত যা ছিল ফ্রান্সের সেরা সাফল্য । এই সাফল্যকে পুঁজি করেই ফ্রান্সের ফুটবল জেগে ওঠে নতুন করে । পরবর্তীতে আবির্ভূত হয় বিশ্বফুটবলের পরাশক্তি হিসেবে । ১৯৯৮ সালে সেই ধারাবাহিকতাতেই বিশ্বকাপ জয় করে ফ্রান্স ।
১৯৯৮ সালে নিজ দেশের মাটিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জয় করে । অবাক করা বিষয় হচ্ছে , ১৯৮৬ সালের পরবর্তী দুইটি বিশ্বকাপের মুল আসরেই খেলার সুযোগ পায় নি ফ্রান্স । একযুগ পর ফিরে এসেই তাদের বিশ্বকাপ জয় ছিল রুপকথার গল্পের মতো । বিশ্বকাপ শুরুর সময় ফ্রান্সের ফিফা র্যাংকিং ছিল ১৮ । তাদের চেয়ে ফিফার বিবেচনায় এগিয়ে ছিল মেক্সিকো , জাপান , মরক্কো , কলম্বিয়া আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । আসলে বিশ্বকাপের মতো আসরে ফিফা র্যাংকিং কোন বিষয় না । মাঠের খেলার সেটাই প্রমাণ করে ফ্রান্স ফাইনালে সেই সময়ের এক নাম্বার দল ব্রাজিলকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়ে । ফাইনালে জোড়া করেন জিনেদিন জিদান । বিশ্বকাপ জয়ের পর রাতারতি অধিনায়ক দিদিয়ের দেশাম্পসহ অন্যরা পরিনত বিশ্বতারকায় ।
চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ২০০২ সালের বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়ে আবারও বিস্ময়ের জন্ম দেয় ফ্রান্স । তবে আবারও ২০০৬ সালের ফাইনালে জায়গা করে নিয়ে দেখায় নিজেদের সামর্থ্য । যদিও হেরে যায় ইটালির কাছে । পরবর্তীতে ২০১৮ সালে আরো একবার ফাইনালে জায়গা করে নেয় ফ্রান্স । এবার আর কোন ভুল হয় নি । রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত একপেশে ফাইনালে ফ্রান্স ৪-২ গোলে হারায় ক্রোয়েশিয়াকে । জয় করে নিজেদের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ । দলের কিলিয়ান এমবাপ্পে পান আসরের সেরা উদীয়মান তারকার পুরস্কার । করেন চারটি গোল । সাথে চারটি গোল ছিল এন্থইন গ্রিজম্যানের ।
ফ্রান্সের কিংবদন্তীঃ
এক সময় ফ্রান্সের ফুটবলের মহানায়ক ছিলেন মিশেল প্লাটিনি । তাকেই মনে করা হত ফ্রান্সের সর্বকালের সেরা । যদিও পরবর্তীতে সেই আসন কেঁড়ে নিয়েছেন জিনেদিন জিদান । ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন জিদান । উঠিয়েছেন ২০০৬ সালের ফাইনালে । ইটালির বিপক্ষেও ফাইনালে গোল করে দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন । কিন্তু শেষেরদিকে মাথা গরম করে প্রতিপক্ষের মাতারাজ্জিকে ঢুস মেরে ‘লাল কার্ড’ দেখেন । ফ্রান্স হেরে যায় টাইব্রেকারে । এখনও ফরাসীদের বিশ্বাস , ফাইনালে মাথা গরম না করে মাঠে থাকলে তাদের প্রিয় ‘জিজ্জু’ দেশকে এনে দিতেন দ্বিতীয় বিশ্বকাপ । এছাড়া, দুইটি বিশ্বকাপ ফাইনালে খেলা জিদান পেতে পারতেন দুইটি ‘গোল্ডেন বল’ । কিন্তু দুই আসরেই লাল কার্ড থাকায় সেটা হয়ে ওঠেনি ।
ফ্রান্সের হয়ে জিদান ১০৮ ম্যাচে করেছেন ৩১ গোল । বিশ্বকাপ ছাড়াও ২০০০ সালে দেশকে এনে দিয়েছেন ইউরোপিয়ান সেরার ট্রফি । ১৯৯৮ সালে জিতেছেন ‘ব্যালন ডি অর’ । তিনবার হয়েছেন ফিফার বর্ষসেরা ফুটবলার । ক্লাব ফুটবলেও তুমুল সফল জিদান নিজ দেশের বোর্দো , জুভেন্টাস আর রিয়েল মাদ্রিদের হয়ে উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগসহ জিতেছেন ১২টি শিরোপা । ক্লাব ক্যারিয়ারে ৬৯৫ ম্যাচে ১২৫ গোল আছে জিদানের । জিদান শুধু নিজের সময়ের না , সর্বকালের অন্যতম সেরা মধ্যমাঠের ফুটবল-শিল্পী ।
ফুটবল থেকে সরে যাওয়ার পর জিদান ম্যানেজার হিসেবে টানা তিনটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগসহ রিয়েলকে জিতিয়েছেন ১১টি ট্রফি । ২০১৭ সালে পেয়েছেন ফিফা’র বর্ষসেরা কোচের সম্মান । ২০২২ সালের বিশ্বকাপের পর ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে জিদানের ।
জিদানের কাছে রাজত্ব হারাবার আগে প্লাটিনি ছিলেন ফ্রান্সের সর্বকালের সেরা । ১৯৮২ সালে প্রথমবার তিনি ফ্রান্সকে তুলে আনেন বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল মঞ্চে । ১৯৮৬ সালে পাইয়ে দেন তৃতীয় স্থান ।তাঁর সময়েই ফ্রান্স টানা দুইটি বিশ্বকাপ সেমিতে খেলেছে । দেশের হয়ে প্লাটিনি ১৯৭৬-৮৭ পর্যন্ত ৭২ ম্যাচে করেছেন ৪১ গোল । ১৯৮৪ সালে তিনিই প্রথম ফ্রান্সকে জিতিয়েছিলেন উয়েফা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ । আসরে ৯ গোল করে ছিলেন সেরা গোলদাতা । দুইবার তিনি জিতেছেন ফ্রান্সের বর্ষসেরার পুরস্কার । তিনবার জিতেছেন ব্যালন (সেই সময়ে শুধু ইউরোপের ফুটবলারদের দেয়া হত) ।ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন ন্যান্সি , সেইন্ট এতিয়েন আর জুভেন্টাসের হয়ে । জিতেছেন ১০টি ট্রফি । অবসরের পর তিনি ফ্রান্স জাতীয় দলের কোচ হিসেবে অবশ্য ব্যর্থ ছিলেন । ১৯৮৮-৯২ পর্যন্ত দায়িত্বে তিনি ফ্রান্সকে তুলতে পারেন নি বিশ্বকাপের মুলমঞ্চে ।
এছাড়া ফ্রান্সের সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের তালিকায় জ্যা টিগানা , রেমন্ড কেপা , জ্যা ফন্টেইন , থিয়েরি অরি , জ্যা পিয়েরে প্যাপিন , দিদিয়ের দেশাম্প , এরিক কাতোয়া , লিলিয়ান থুরাম , লরেন্ট ব্ল , ফেবিয়েন বার্থেজের নাম নিতে হবে সম্মানের সাথে ।
ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে বেশী ১৪২ ম্যাচ খেলেছেন লিলিয়ান থুরাম । তবে বর্তমান কিপার হুগো লরিস ১৩৯ ম্যাচ খেলে সেই রেকর্ড ভাঙার অপেক্ষায় । আর চারটি ম্যাচ খেললেই লরিস হয়ে যাবেন ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে বেশী আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা ফুটবলার ।
ফ্রান্স জাতীয় দলের হয়ে সবচেয়ে বেশী ৫১ গোলের মালিক থিয়েরি অরি । তবে অলিভার জিরুদ ৪৯ গোল নিয়ে অপেক্ষায় আছেন সেই রেকর্ড ভাঙার ।
রোড টু কাতারঃ
২০০২ সাল পর্যন্ত আগের আসরের চ্যাম্পিয়নদের বিশ্বকাপ বাছাই খেলতে হত না । কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বকাপ খেলতে চ্যাম্পিয়নদেরও অংশ নিতে হচ্ছে বাছাই পর্ব । এখন শুধু স্বাগতিক দেশ সরাসরি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় । বাকী ৩১ দলকে বাছাই পর্বের লড়াই পেরিয়ে আসতে হয় বিশ্বকাপে । ফ্রান্সকেও তাই বর্তমান নিয়মে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েও পেরুতে হয়েছে বাছাইয়ের বাঁধা । আর সেটা তারা করেছে দাপটের সাথেই ।
ইউরোপিয়ান অঞ্চলে ‘ডি’ গ্রুপে ফ্রান্সের সঙ্গী ছিল ইউক্রেইন , ফিনল্যান্ড , বসনিয়া আর কাজাখস্তান । যদিও ফ্রান্সকে সেভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে নি কেউই । আট ম্যাচে ১৮ পয়েন্ট নিয়ে অপরাজিত থেকেই ফ্রান্স জায়গা করে নিয়েছে কাতার বিশ্বকাপে ।
ফ্রান্সের হয়ে বাছাইয়ে ছয় গোল করেছেন আন্থইন গ্রিজম্যান । পাঁচটি গোলের দেখা পেয়েছেন কিলিয়ান এমবাপ্পে । আর তিনটি গোল করেছেন করিম বেঞ্জেমা । অর্থাৎ ফ্রান্সের আক্রমণভাগ এই মুহূর্তে সবার সেরা ।
বাছাই পর্বে ফ্রান্স মোট গোল করেছে ১৮টি আর হজম করেছে মাত্র ৩টি ।
ফ্রান্সের সাম্প্রতিক পারফর্মেন্সঃ
২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ফ্রান্স খেলেছে আটটি ম্যাচ । যার মধ্যে জয় মাত্র তিনটি । ড্র দুইটি । আর পরাজয় তিনটি । বিশেষ করে উয়েফা নেশন্স লীগের গ্রুপ পর্ব থেকে ফ্রান্সের বিদায় ছিল দুঃখজনক । দুইটি ম্যাচ তারা হেরেছে ডেনমার্কের বিপক্ষে আর অন্যটি ক্রোয়েশিয়ার সাথে । আসরের ছয় ম্যাচের একটি জয় ছিল অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে । দুইটি ড্র ক্রোয়েশিয়া আর অস্ট্রিয়ার সাথেই ।
সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে ফ্রান্স দলের পারফর্মেন্স খুব আশাব্যঞ্জক নয় , যা দিয়ে বিশ্বকাপের ফেভারিট ‘তকমা’ দেয়া যায় তাদের ।
তারকার অভাব নেইঃ
ফ্রান্স দলের বড় তারকা কিলিয়ান এমবাপ্পে । ইতোমধ্যেই ২০১৮ সালে টিন-এজ বয়সে ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছেন তিনি । হয়েছিলেন রাশিয়া বিশ্বকাপের সেরা উদীয়মান তারকা । মাত্র ১৯ বছরের এমবাপ্পে ফ্রান্সের হয়ে সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপ গোলের দেখা পান । নক আউট পর্বে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জোড়া গোল করে হয়ে যান ফুটবল কিংবদন্তী পেলের পর সবচেয়ে কম বয়সী ফুটবলার হিসেবে জোড়া গোলের মালিক । একই সঙ্গে পেলের পর ফাইনালে গোল করেন সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে । ২০২০-২১ মৌসুমের নেশন্স লীগে দুই গোল আর দুই এসিস্ট নিয়ে সেরা গোলদাতা হয়েছিলেন এমবাপ্পে । ইতোমধ্যে ফ্রান্সের হয়ে ৫৯ ম্যাচে ২৮ গোল তার নামের পাশে ।
২০১৭ সালের ‘গোল্ডেন বয়’ এমবাপ্পেকে ধরা হচ্ছে আগামীদিনের ফুটবল শাসক । ইতোমধ্যে দুইবার ফ্রান্সের বর্ষসেরা নির্বাচিত হয়েছেন তিনি । হয়েছেন ২০২১-২২সহ টানা চার মৌসুমে লীগ ওয়ানের সেরা গোলদাতা । চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত পিএসজির জার্সিতে ১৭ ম্যাচে ১৭ গোল করেছেন ।
৩১ বছর বয়সী ফরোয়ার্ড গ্রিজম্যান দেশের জার্সিতে ১১০ ম্যাচে ৪২ গোল করেছেন । ক্লাবফুটবলেও ৬১২ ম্যাচে ২৩৪ গোল আছে তাঁর । যদিও বার্সেলোনা থেকে ধারে এথলেটিকো মাদ্রিদে সবশেষ মৌসুমটা একেবারেই ভাল যায় নি । করেছেন ৩৬ ম্যাচে মাত্র আটটি গোল । ২০১১-১২’র পর এটাই তার সবচেয়ে বাজে ঘরোয়া ফুটবল মৌসুম । আর চলতি মৌসুমে তো মাঠে নামার সুযোগ পাচ্ছেন না নিয়মিত । ২০১৬ সালে ইউরোপিয়ান গোল্ডেন বুট আর ফ্রান্সের বর্ষসেরা হয়েছেন । এখনও জাতীয় দলে নিজের সেরাটা দেয়ার ক্ষমতা রাখেন ।
২৯ বছরের রাফায়েল ভারানে বড় তারকা । তিনিও ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ আর নেশন্স লীগ জিতেছেন । জাতীয় দলে তার ম্যাচ সংখ্যা ৮৭টি , আছে ৫টি গোল । ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ভারানে দূরপাল্লার শটে গোল করেন । যা পুরো আসরের সেরা গোল নির্বাচিত হয় । দীর্ঘ ১০টি বছর রিয়েল মাদ্রিদে কাটিয়ে ২০২১ সাল থেকে ইংলিশ জায়ান্ট ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে আছেন তিনি ।
২৬ বছর বয়সী বেঞ্জামিন পাভার্ড ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ আর নেশন্স লীগ জিতেছেন । দেশের হয়ে খেলেছেন ৪২ ম্যাচ , করেছেন দুইটি গোল । ২৬ বছরের এই রাইট ব্যাক খেলতে পারেন সেন্টার ব্যাক হিসেবেও । বর্তমানে বায়ার্ন মিউনিখের অন্যতম সদস্য তিনি ।
২৪ বছরের তরুণ থিও হার্নান্দেজ খেলতে চলেছেন তার প্রথম বিশ্বকাপ । ইতোমধ্যে ২০২০-২১ মৌসুমে নেশন্স লীগ জেতা হয়ে গেছে তার । ২০১৯-২০ মৌসুমে ইটালিয়ান ক্লাব এসি মিলানের বর্ষসেরা ছিলেন । সর্বশেষ মৌসুমে এসি মিলানের লীগ শিরোপা জয়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন এই লেফট ব্যাক । খেলছেন ক্লাবের হয়ে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৪০ ম্যাচ । সিরি ‘এ’ তে করেছেন সর্বশেষ মৌসুমে পাঁচ গোল ।
দলের আরও দুই বড় তারকা পল পগবা আর এন’গোলো কন্তে সাম্প্রতিক সময়ে ইনজুরি আর ফর্মহীনতায় ভুগছেন । তাদের দুজনের আছে ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ জয়ের অভিজ্ঞতা । তবে কাতার বিশ্বকাপে তাদের সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা কম । আর স্কোয়াডে থাকলেও তারা প্রথম একাদশে সুযোগ পাবেন কিনা , এই নিয়ে সন্দেহ আছে ।
বেঞ্জেমার রাজসিক প্রত্যাবর্তনঃ
কাতার বিশ্বকাপে নজর থাকবে করিম বেঞ্জেমার উপর । ২০১৫ সালের পর থেকে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক ফুটবলের বাইরে । সে সময়ের জাতীয় দল সতীর্থ ম্যাথু ভালবুয়েনার স্পর্শকাতর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় বেঞ্জেমার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছিল। ওই ঘটনার পর জাতীয় দলে ব্রাত্য হয়ে পড়েন বেঞ্জেমা । নিষিদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত ফ্রান্সের হয়ে ৮১ ম্যাচে ২৭ গোল করেছিলেন বেঞ্জু । তবে সর্বশেষ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের স্কোয়াডে বেঞ্জেমাকে রেখে চমক দেখান দেশাম্প । যদিও সেই আসরে নক আউট পর্বের বেশী এগুতে পারে নি ফরাসীরা । ৩-৩ গোলে ড্র ম্যাচের পর টাইব্রেকারে ফ্রান্স হেরে যায় সুইজারল্যান্ডের কাছে । তবে আসরের চার ম্যাচে চার গোল করে ফরাসী দলে নিজের প্রত্যাবর্তন ঠিকই জানান দেন । ইউরো আসরে তার জোড়া গোল ছিল পর্তুগাল আর সুইসদের বিপক্ষে ।
ইউরো আসরে ব্যর্থ হলেও নেশন্স লীগের শিরোপা ঠিকই জয় করে ফ্রান্স । সেমি ফাইনালে বেলজিয়াম আর স্পেনের বিপক্ষে ফাইনালে গোল করে দেশের শিরোপা জয়ে বেঞ্জেমা রাখেন বড় ভূমিকা । স্পেনের বিপক্ষে ফাইনালে করা তার গোলটি আসরের সেরা নির্বাচিত হয় । এখন পর্যন্ত জাতীয় দলে বেঞ্জেমার ৯৪ ম্যাচে গোলের সংখ্যা ৩৬টি । দুর্দান্ত ফর্মে থাকা বেঞ্জু জাতীয় দলের ফেরার পরবর্তী ১৩ ম্যাচেই করেছেন ৯ গোল ।
শুধু জাতীয় দল না , বেঞ্জেমা দুর্দান্ত ছন্দে আছেন রিয়েলের জার্সিতেও । ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো পরবর্তী যুগে বেঞ্জেমাই পথ দেখিয়ে চলেছেন রিয়েল মাদ্রিদকে । জিতিয়েছেন ২০২১-২২ মৌসুমের লা লিগা , উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ আর উয়েফা সুপার কাপ । চ্যাম্পিয়ন্স লীগে ১৫ গোল করে হয়েছেন সেরা গোলদাতা ।সর্বশেষ লা লিগায় ২৭ গোল করে জিতেছেন ‘পিচিচি’ । জিতেছেন উয়েফা বর্ষসেরা আর ব্যালন ডি অর ।
২০১৮ সালের বিশ্বকাপে বেঞ্জেমা খেলতে পারেন নি নিষেধাজ্ঞার কারণে । যদিও ২০১০ আর ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ খেলেছেন । ৩৫ বছর বয়সী এই ফুটবলার জীবনের শেষ বিশ্বকাপ রাঙাতে চাইবেন নিজের মতো করে ।
নতুন তারকাঃ
২০১৮ সালের বিশ্বকাপের পর ফ্রান্স দলে যোগ হয়েছে চুয়ামেনি , কামাভিঙ্গা , ক্রিস্টোফার এনকুকু , জুলস কুন্ডের মতো তারকা । যারা নিয়মিত একাদশে জায়গা পাওয়ার লড়াইয়ে পেছনে ফেলছেন অন্যদের । এটা ফ্রান্সের জন্য সুখবর । সিনিয়র আর অভিজ্ঞদের সাথে নতুন প্রতিভার সমন্বয়ে ফ্রান্স দলটি কাতারেও দেখাতে পারে সেরা কিছু , এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না ।
কোচ নিজেই দলের সবচেয়ে বড় তারকাঃ
সব কিছু ঠিক থাকলে কাতার বিশ্বকাপে তারকার সম্মিলন ঘটতে চলেছে ফ্রান্স দলে । দলের কোচ দিদিয়ের দেশাম্প তো নিজেই সবচেয়ে তারকা । তার অধিনায়কত্বে ফ্রান্স ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ আর ২০০০ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে ।
২০১২ সাল থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন দলের কোচ হিসেবে । ২০২২ সালের বিশ্বকাপ জিতলে তিনি হবেন ফুটবল ইতিহাসের দ্বিতীয় কোচ যিনি জিতবেন দুইটি শিরোপা । ১৯৩৪ আর ১৯৩৮ সালে ইটালিকে বিশ্বকাপ জিতিয়েছিলেন ভিট্টরিও পোৎজো । এছাড়া ২০২০-২১ মৌসুমে ফ্রান্স দেশাম্পের অধীনে জিতেছে উয়েফা নেশন্স লীগ ।
ফ্রান্সের কোচ হিসেবে ১৩২ ম্যাচে ৮৪ জয় পেয়েছেন দেশাম্প । ড্র ২৭ ম্যাচে আর পরাজয় ২১ টি ।
কাতার বিশ্বকাপে ফ্রান্সকে ৩-৪-১-২ ফর্মেশনে খেলাতে পারেন দেশাম্প । সেইক্ষেত্রে তাঁর একাদশ হবে –হুগো লরিস (গোলরক্ষক) , জুলস কুন্ডে , রাফায়েল ভারানে , লুকাস হার্নান্দেজ , বেঞ্জামিন পাভার্ড , অরেলিন চুয়ামেনি , এডুয়ার্ডো কামাভিঙ্গা , থিও হার্নান্দেজ , এন্থইন গ্রিজম্যান , করিম বেঞ্জেমা , কিলিয়ান এমবাপ্পে ।
গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেবে ফ্রান্স?
কাতার বিশ্বকাপে ‘ডি’ গ্রুপে খেলবে ফ্রান্স । যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ডেনমার্ক , তিউনিশিয়া আর অস্ট্রেলিয়া । ২২ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ অভিযান । দুইদলের পাঁচবারের দেখায় ফ্রান্সের জয় তিনটি আর ড্র একটি । ২০০১ সালে ফিফা কনফেডারেশনস কাপে অবশ্য অস্ট্রেলিয়া ১-০ গোলে হারিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্সকে । তবে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে একই গ্রুপে থাকা অস্ট্রেলিয়াকে ২-১ গোলে হারিয়েছিল ফ্রান্স ।
২৬ নভেম্বর ফ্রান্স বড় ঝামেলায় পড়তে পারে ডেনমার্কের বিপক্ষে । ডেনিশরা ১৬ বারের দেখায় ছয়টি জয় পেয়েছে ফ্রান্সের বিপক্ষে । হার আটটি আর ড্র দুইটি । চলতি বছর নেশন্স লীগের দুইবারের দেখায় ফ্রান্সকে বধ করেছে ডেনমার্ক । ২০১৮ বিশ্বকাপের গ্রুপ ম্যাচে দুই দলের কেউ গোল করতে পারেনি ।
৩০ নভেম্বর গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে ফ্রান্সের প্রতিপক্ষ তিউনিশিয়া । যাদের বিপক্ষে অতীতের পাঁচ দেখায় দুইটি জয়ের সাথে একটি করে ড্র আর হার আছে ফরাসীদের । তাই নিশ্চিত করে বলা যায় না কিছু ।
ফ্রান্স বিশ্বকাপ স্কোয়াডঃ
গোলরক্ষক- হুগো লরিস , আলফান্সো আরিওলা , মাইক মেগনান
রক্ষণভাগ- বেঞ্জামিন পাভার্ড , রাফায়েল ভারানে , প্রেসনেল কেমবাপ্পে , , লুকাস হার্নান্দেজ , থিও হার্নান্দেজ , লুকাস ডিগ্নে , জুলস কুন্ডে , ক্লেমন্ট লেংলেট , ফারল্যান্ড মেন্ডি
মধ্যমাঠ- জোনাথন ভেরেটুট , আদ্রিয়েন র্যাবিয়ট , এডুয়ার্ডো কামাভিঙ্গা , অরিলিয়েন চুয়ামেনি , পল পগবা , মাতেও গুয়ান্ডেজি , এন’গোলঅম কান্তে
ফরোয়ার্ড- উইসাম বেন ইয়েডার , অলিভার জিরুদ , এন্থইন গ্রিজম্যান , কিলিয়ান এমবাপ্পে , করিম বেঞ্জেমা , উসমান ডেম্বেলে , ক্রিস্টোফার এন’কুকু
সর্বশেষঃ
২০১০ সাল থেকে বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন দলগুলো বিদায় নিচ্ছে প্রথম রাউন্ড থেকে ।২০০২ সালে ফ্রান্স নিজেরাও একই পরিনতির শিকার হয়েছিল । অনেকের মনেই শংকা , ফ্রান্সের ভাগ্যেও কি এমন পরিনতি অপেক্ষা করছে ! মনে হয় না । ফ্রান্স বরং টার্গেট করেছে পেলের ব্রাজিলের পর টানা দুইটি বিশ্বকাপ জয়ের । যার পুরোধা হিসেবে থাকছেন অবশ্যই কিলিয়ান এমবাপ্পে । ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে পেলের অনেক রেকর্ড ভেঙেছেন এমবাপ্পে । এবার সুযোগ ব্রাজিলের কালো-মানিকের টানা দুই বিশ্বকাপ জয়ে সমকক্ষ হওয়ার । সেটার জন্য ফ্রান্স আর এমবাপ্পে নিজেদের সামর্থ্যের সেরাটা উজাড় করে দিতে প্রস্তুত । সেটা হলে ফ্রান্স উঠে যাবে অনন্য উচ্চতায় । আর কিলিয়ান এমবাপ্পেও পেলেকে ছাপিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে পাবেন ।
আহসান/বিশ্বকাপ-১৫