Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

ওয়েলসঃ উপস্থিতি কম চমক বড়

আহসান হাবীব সুমনঃ

ফুটবলের বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ – যে কোন প্রতিযোগিতাতেই ওয়েলসের অংশগ্রহণ সীমিত । গ্রেট ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত দেশটি ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের মুল পর্বে সুযোগ পেয়েছে মাত্র দুইবার । ফুটবল বিশ্বকাপেও মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো অংশ নিতে চলেছে তারা । কিন্তু ইতিহাস বলছে , যখনই ফুটবলের মহাদেশীয় কিংবা বিশ্বআসরে খেলেছে ওয়েলস ,  উপহার দিয়েছে  চমকে  যাওয়ার  মতো পারফর্মেন্স । কাতার বিশ্বকাপেও কি থাকছে ওয়েলসের চমক?

নাটকীয়ভাবে কাতার বিশ্বকাপে ওয়েলসঃ

কাতার বিশ্বকাপে ওয়েলসের টিকেট পাওয়ার ঘটনা কোন শ্বাসরুদ্ধ নাটকের চেয়ে কম না । ইউরোপিয়ান অঞ্চলের গ্রুপ পর্বের বাঁধা সরাসরি পেরুতে পারেনি দলটি । খেলতে হয়েছে ‘প্লে-অফ’ পর্বের কঠিন দুইটি ম্যাচ । সে কথায় পরে আসি । শুরুতেই আলোচনা করা যাক ওলেসের গ্রুপ পর্বের পারফর্মেন্স নিয়ে ।

উয়েফা অঞ্চলের ‘ই’ গ্রুপে ওয়েলসের সঙ্গী ছিল বেলজিয়াম , চেক রিপাবলিক , বেলারুশ আর এস্তোনিয়া । ফিফা র‍্যাংকিংয়ে সেই সময়ের শীর্ষদল (বর্তমানে দ্বিতীয়) বেলজিয়াম শুরু থেকেই ছিল ফেভারিট । ফেভারিটদের মতই ৮ ম্যাচে ২০ পয়েন্ট নিয়ে ইউরোপের ‘রেড ডেভিল’খ্যাত বেলজিয়াম সরাসরি নাম লেখায় কাতার বিশ্বকাপে । কিন্তু দ্বিতীয়স্থানে থেকে প্লে-অফ পর্বে জায়গা পাওয়ার জন্য চেক রিপাবলিক আর ওয়েলসের মধ্যে লড়াই ছিল তীব্র । যা শেষ রাউন্ড পর্যন্ত গড়িয়েছে । গ্রুপের শেষ ম্যাচে চেকরা ২-০ গোলে হারায় এস্তোনিয়াকে । তাদের পয়েন্ট দাঁড়ায় ৮ ম্যাচে ১৪ । সমান পয়েন্ট নিয়ে নিজেদের শেষ ম্যাচে বেলজিয়ামের মুখোমুখি হয় ওয়েলস । এই ম্যাচ হেরে গেলেই চেকদের সাথে তাদের পয়েন্ট সমান থেকে যেতো । সেই ক্ষেত্রে ‘হেড টু হেড’ আর গোল-ব্যবধানের হিসেব নিকেশ চলে আসত । কিন্তু কার্ডিফে  পিছিয়ে  পড়েও স্বাগতিক  ওয়েলস ম্যাচটি ড্র করে ১-১ গোলে । অর্থাৎ ৮ ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট নিয়ে প্লে-অফে জায়গা করে নেয়   ওয়েলস ।

বাছাই পর্বের ‘ই’ গ্রুপে ওয়েলসকে প্রায় সমান টক্কর দিয়েছে চেকরা । দুই দলই গ্রুপের সেরা বেলজিয়ামের বিপক্ষে একটি করে ম্যাচ হেরেছে , অন্যটি ড্র করেছে । তবে নিজেদের মাঠে ওয়েলস ১-০ গোলে হারিয়েছিল চেকদের । যা চেকরা পারেনি । ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রাগে অনুষ্ঠিত ম্যাচটি ২-২ গোলে ড্র হয় । মুলত এই একটি মহামূল্যবান পয়েন্ট ওয়েলসকে এগিয়ে দিয়েছে প্লে-অফের দিকে । কারণ ঘরের মাঠের সুবিধা ওয়েলস নিতে পারলেও ব্যর্থ ছিল চেকরা । 

২০২২ সালের বিশ্বকাপে ইউরোপিয়ান প্লে-অফ ছিল ভিন্ন ধারার । আগের মতো দুই দলের মধ্যে ‘হোম এন্ড এওয়ে’ লড়াই নয় । বরং একটি গ্রুপে  চার দলের নক আউট আয়োজন ছিল । যেখানে  ওয়েলস  প্রথম ম্যাচে ২-১ গোলে হারায় অস্ট্রিয়াকে । আরেক ম্যাচে ইউক্রেইন ৩-১ গোলে জিতে যায় স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে । ফরম্যাট অনুসারে নক আউট প্লে-অফের চূড়ান্ত ম্যাচে মুখোমুখি হয় ওয়েলস আর ইউক্রেইন । যেখানে অনেকটা ভাগ্যের জোরে ১-০ গোলের জয় পায় ওয়েলস । আর নাম লেখায় বিশ্বকাপে ।

ওয়েলসের ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন । কারণ প্লে-অফের দুইটি ম্যাচই ছিল কার্ডিফের স্টেডিয়ামে । যদিও চলতি বছরের ৫ জুন প্রতিপক্ষের মাঠেও দাপটের সাথে খেলেছে ইউক্রেইন । প্রথমার্ধে গোলের সুযোগও তারাই পেয়েছে বেশী  । কিন্তু গোলের দেখা তো পায়নিই , উল্টো ৩৪ মিনিটে গোল হজম করে তারা ।  বাঁ পাশে বক্সের কিছুটা বাইরে থেকে নেওয়া গ্যারেথ বেলের ফ্রি-কিক বিপদমুক্ত করতে হেড করেছিলেন ইউক্রেন অধিনায়ক আন্দ্রিই ইয়ারমোলেঙ্কো। বল তাঁর মাথায় লেগে চলে যায় নিজেদের জালে। শেষ পর্যন্ত এই এক গোলেই স্বপ্নভঙ্গ হয় ইউক্রেইনের । আর ৬৪ বছর পর দ্বিতীয়বারের মতো ওয়েলস পা রাখে বিশ্বকাপে ।

বড় আসর মানেই  ওয়েলসের  চমকঃ

বড় আসরে একেবারেই অনিয়মিত ওয়েলস । নিজ মহাদেশের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের মুল পর্বেই সুযোগ পেয়েছে মাত্র দুইবার । ২০১৬ সালে প্রথম অংশগ্রহণেই সেমি ফাইনালে উঠে তাক লাগিয়ে দেয় সবাইকে । গ্রুপ পর্বে তারা হারিয়েছিল রাশিয়া আর স্লোভাকিয়াকে । যদিও হেরে যায় ইংল্যান্ডের কাছে । নক আউট পর্বে তাদের কাছে হার মানে নর্দান আয়ারল্যান্ড । তবে সবচেয়ে বড় চমক তারা দেয় কোয়ার্টার ফাইনালে বেলজিয়ামকে ৩-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে । সেমিতে অবশ্য ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালের সামনে টিকতে পারেনি । হেরে যায় ২-০ গোলে । পরে পর্তুগাল জয় করে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম ইউরো ।

২০২১ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপেও নক আউট পর্বে খেলে ওয়েলস ।

বিশ্বকাপে ওয়েলসের একমাত্র অংশগ্রহণ ১৯৫৮ সালে । সুইডেনে অনুষ্ঠিত সেই আসরের কোয়ার্টার পর্যন্ত ছিল তাদের পথচলা । যদিও আসরে পায় নি কোন জয়ের দেখা । গ্রুপের তিন ম্যাচেই ড্র করে হাঙ্গেরি , মেক্সিকো আর স্বাগতিক সুইডেনের বিপক্ষে । পরবর্তীতে ফাইনাল খেলা সুইডেনের পেছনে থেকে গ্রুপের দ্বিতীয় দল হিসেবে নাম লেখায় কোয়ার্টার ফাইনালে ।

১৯৫৮ বিশ্বকাপের ওয়েলস

সুইডেনে অনুষ্ঠিত  বিশ্বকাপে অংশ নেয় ১৬ দেশ । চার গ্রুপের সেরা আট দল নিয়ে আয়োজন ছিল কোয়ার্টার ফাইনালের । সেরা আটের লড়াইয়ে ব্রাজিলের কাছে দুর্দান্ত লড়াইয়ের পর ওয়েলস হারে ০-১ গোলে । সেই ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন ফুটবলের কালো-মানিক পেলে । সেই আসরে ব্রাজিল ছিল অপ্রতিরোধ্য । যারা শেষ পর্যন্ত জিতে নেয় নিজেদের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ । আর সেটাই এখন পর্যন্ত ইউরোপ থেকে কোন ল্যাটিন দেশের প্রথম বিশ্বকাপ জয় ।

১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই হাঙ্গেরির সাথে ১-১ গোলে ড্র করে ওয়েলস । ম্যাচের ২৭ মিনিটে ওয়েলসের পক্ষে সমতাসুচক গোল করেন উইলিয়াম জন চার্লস । বনে যান ওয়েলসের ইতিহাসের প্রথম বিশ্বকাপ গোলদাতা ।

১৯৫৮ সালের পর টানা ১৫টি বিশ্বকাপ আসরের চূড়ান্ত পর্বে ওয়েলস ছিল দর্শক হয়ে । অবশেষে ৬৪ বছর পর দলটি ফিরছে বিশ্বকাপের মুলমঞ্চে ।

আন্তর্জাতিক ফুটবলে বড় কোন শিরোপা পায় নি ওয়েলস । তবে গ্রেট ব্রিটেনের চার সদস্য ইংল্যান্ড , স্কটল্যান্ড , আয়ারল্যান্ড আর ওয়েলসকে নিয়ে এক সময় অনুষ্ঠিত হত ‘ব্রিটিশ হোম চ্যাম্পিয়নশিপ’ । ১৮৮৩-৮৪ থেকে ঠিক একশো বছর অর্থাৎ ১৯৮৩-৮৪ পর্যন্ত নিয়মিত হয়েছে এই টুর্নামেন্ট । যেখানে ওয়েলসের শিরোপা আছে ১২টি ।

ওয়েলসের কালজয়ী ফুটবলারঃ

ওয়েলসের কালজয়ী ফুটবলারদের মধ্যে শুরুতেই চলে আসবে জন চার্লসের নাম ।  তিনি ওয়েলসের পক্ষে বিশ্বকাপে প্রথম গোলদাতা হিসেবেও চিরস্মরণীয় । চার্লসের আরেকটি রেকর্ড হচ্ছে খেলোয়াড়ী জীবনে কখনও হলুদ কিংবা লাল কার্ড দেখেন নি । যা ইতিহাসের বিরল । এছাড়া ১৯৯৭ সালে তিনি সমর্থকদের ভোটে জুভেন্টাসের সর্বকালের সেরা বিদেশী ফুটবলার নির্বাচিত হন । সেন্টার ফরোয়ার্ড পজিশনে জাতীয় দলের জার্সিতে ৩৮ ম্যাচে ১৫ গোল আছে তার । ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন ইটালির রোমা , জুভেন্টাস আর ইংল্যান্ডের লিডস ইউনাইটেডে । ক্লাব ফুটবলে তার গোলের সংখ্যা ২৮৪ ।

জন চার্লস ক্যারিয়ারের সেরা সময় কাটিয়েছেন জুভেন্টাসে । ১৯৫৭-৫৮ থেকে পাঁচটি মৌসুম ছিলেন তুরিনের বুড়িদের সাথে । সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ১৭৯ ম্যাচে করেছেন ১০৫ গোল । শিরোপা জিতেছেন সব দল মিলিয়ে সাতটি । যার মধ্যে ইটালিয়ান সিরি ‘এ’ তিনটি । দুইবার ইটালি আর ইংল্যান্ডের লীগে সেরা গোলদাতা ছিলেন । ১৯৫৯ সালের ব্যালন ডি অর’ এ আলফ্রেড ডি স্টেফানো আর ফ্রান্সের রেমন্ড কোপার পেছনে থেকে তৃতীয় হয়েছেন । কখনও প্রতিপক্ষের কোন খেলোয়াড়কে হার্ড-ট্যাকল না করায় তিনি পরিচিতি পান ‘ জেন্টল জায়ান্ট’ নামে ।

ওয়েলসের আরও একজন বড় তারকা রায়ান গিগস । যাকে বর্তমান সময়ের ফুটবল দর্শকরাও চেনে এক নামে । ছিলেন ওয়েলসের অধিনায়ক । খেলেছেন গ্রেট ব্রিটেনের সম্মিলিত দলের হয়ে ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকে । বিশ্বের সর্ববৃহৎ ক্রীড়া-আসরে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের ফুটবল দলের অধিনায়ক । আন্তর্জাতিক ফুটবলে দেশের হয়ে ১৯৯১-২০০৭ পর্যন্ত খেলেছেন ৬৪ ম্যাচ । করেছেন ১২ গোল । কিন্তু কখনও দলকে বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোর চূড়ান্তপর্বে নিয়ে যেতে পারেন নি । নিজ সময়ের অন্যতম পরিপূর্ণ ফুটবলার হিসেবে খ্যাতি পাওয়া গিগসের খেলোয়াড়ী জীবনে যা একটি বড় আক্ষেপ হয়ে থাকবে ।

ক্লাব ফুটবলে গিগস আজীবন খেলেছেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে । ১৯৯০-২০১৪ পর্যন্ত দীর্ঘ দুই যুগের ক্যারিয়ারে ম্যান ইউকে পরিনত করেন বিশ্বের অন্যতম সেরা দলে । স্যার এলেক্স ফার্গুসনের অন্যতম সৈনিক হিসেবে ছিলেন ৩৪টি শিরোপা জয়ের অংশীদার । যার মধ্যে ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগ ১৩টি আর উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ দুইটি । ২০০৮-০৯ মৌসুমে ছিলেন ইংলিশ লীগের সেরা খেলোয়াড় । ছিলেন ২০০৯ সালে ‘বিবিসি’র নির্বাচিত বিশ্বসেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব । ২০১১ সালে জিতেছেন ‘গোল্ডেন ফুট’ ।

ম্যান ইউর হয়ে অনেক রেকর্ড আছে গিগসের নামের পাশে । তিনি সর্বোচ্চ প্রিমিয়ার লীগ শিরোপার মালিক । টানা ২২ প্রিমিয়ার লীগ খেলা একমাত্র ফুটবলার । প্রিমিয়ার লীগের সবচেয়ে বেশী ১৬২ এসিস্ট তার নামের পাশে । টানা ২১ প্রিমিয়ার লীগে গোল করা একমাত্র ফুটবলার তিনি । একসময় টানা ১১ চ্যাম্পিয়ন্স লীগে গোল করার রেকর্ডের মালিক ছিলেন গিগস । যা পরে ভেঙে দিয়েছেন রোনালদো আর মেসি । ম্যান ইউর হয়ে সবচেয়ে  বেশী  ৯৬৩ ম্যাচ খেলেছেন গিগস । যার মধ্যে ৭৯৪ ম্যাচেই ছিলেন শুরু থেকে । ম্যান ইউর জার্সিতে ১৬৮ গোলের মালিক তিনি । তিনিই ম্যান ইউর প্রথম সেঞ্চুরিয়ান গোলদাতা ।

রায়ান গিগস সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র অন্যতম সেরা ফুটবলারদের অন্যতম যার কখনও বিশ্বকাপ কিংবা মহাদেশীয় আসরে খেলা হয় নি ।

ওয়েলসের আরেক কিংবদন্তী ইয়ান রাশ । বিগত শতাব্দীর আশি আর নব্বই দশকে তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড । লিভারপুলের হয়ে খেলেছেন ১৫ মৌসুম । এছাড়া জুভেন্টাস , লিডস ইউনাইটেড , নিউ ক্যাসেল ইউনাইটেড আর শেফিল্ড ইউনাইটেডের হয়ে খেলেছেন । তবে সেরা সময় কাটিয়েছেন লিভারপুলের জার্সিতে । ক্লাব ক্যারিয়ারে ৮২৫ ম্যাচে তার গোলের সংখ্যা ৩২৩টি । জিতেছেন ১৯টি শিরোপা , যার সবই অল রেডদের হয়ে । পাঁচটি প্রিমিয়ার লীগের সাথে ইউরোপিয়ান কাপ আছে দুইটি । ১৯৮৪ সালে জিতেছেন ইংলিশ লীগ আর ইউরোপের গোল্ডেন বুট ।বিবিসি’র সেরা ক্রীড়াব্যক্তিত্ব হয়েছেন একই বছর । লিভারপুলের হয়ে আট মৌসুম ছিলেন সর্বোচ্চ গোলদাতা । 

ওয়েলসের হয়ে ৭৩ ম্যাচে ২৮ গোল আছে ইয়ান রাশের । একসময় নিজদেশের সেরা গোলদাতা ছিলেন তিনি । পরে যা ভেঙেছেন গ্যারেথ বেল । এখনও তিনি নিজ দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা । তবে জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ কিংবা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে না পারার কষ্ট নিয়ে তিনিও চলে গেছেন অবসরে ।

ওয়েলসের অন্যান্য মহাতরকাদের মধ্যে চলে আসে গোলরক্ষক নেভিল সাউথহল , মার্ক হিউজেস , গ্যারি স্পিড , বিলি মেরেডিথ আর ক্রেইগ বেলেমির নাম ।

ওয়েলসের আছে একজন গ্যারেথ বেলঃ

ধুমকেতুর মতো একজন গ্যারেথ বেলের উঠে আসা ওয়েলসের জন্য আশীর্বাদ । তাঁর কাঁধে চড়েই ওয়েলস পূরণ করেছে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে খেলার স্বপ্ন । ২০১৬ সালের ইউরো  আসরে সবাইকে চমকে দিয়ে  সেমি ফাইনালেও খেলেছে ওয়েলস । ৬৪ বছর পর বিশ্বকাপের চূড়ান্তপর্বে ওয়েলস পা রেখেছে গ্যারেথ বেলের অধিনায়কত্বেই । প্লে-অফের ফাইনালে ইউক্রেইনের বিপক্ষে তাঁর একমাত্র গোল আবারও ওয়েলসকে নিয়ে এসেছে বিশ্বকাপের মুলমঞ্চে । বেল এখন পর্যন্ত যা করেছেন দেশের হয়ে , তাতে ওয়েলস ফুটবলের সর্বকালের সেরা হয়ে গেছেন ইতোমধ্যে ।

ওয়েলসের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১০৮টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন গ্যারেথ বেল । ১০৯ ম্যাচ খেলা তারই সতীর্থ ক্রিস গুন্টার আছেন শীর্ষে । বেলের আরেক সতীর্থ ওয়েন হেন্সি  খেলেছেন ১০৬ ম্যাচ । দেশের সর্বোচ্চ ৪০টি আন্তর্জাতিক গোলের মালিক বেল । রেকর্ড ছয়বার তিনি জিতেছেন ওয়েলসের বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার ।

২০০৬-০৭ মৌসুমে বেলের ক্যারিয়ার সাউথহ্যাম্পটনে শুরু হয়েছিল লেফটব্যাক হিসেবে । কিন্তু দুর্দান্ত গতিতে ওভার-ল্যাপ করে উপরে উঠে যাওয়ার ক্ষমতার ছিল তাঁর । সাথে নিতে পারতেন ফ্রি-কিক । এছাড়া মাপা ক্রসের সহজাত স্বভাব থাকায় পরবর্তীতে উইঙ্গার হিসেবে খেলা শুরু করেন । পরিনত হন সময়ের সেরা উইঙ্গারে । ২০০৯-১০ মৌসুমে টটেনহ্যাম কোচ হ্যারি রেডন্যাপই তাকে উইঙ্গার পজিশনে নিয়ে আসেন । সেই থেকেই ফুটবল বিশ্ব দেখতে শুরু করে তাঁর ভয়ংকর রুপ ।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে বেল যোগ দেন রিয়েল মাদ্রিদে । তিনি ফুটবলের প্রথম ‘ওয়ান হান্ড্রেড মিলিয়ন ডলার’ ট্র্যান্সফার ফি ম্যান । রিয়েল মাদ্রিদে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো আর করিম বেঞ্জেমার সাথে গড়েন আক্রমণভাগে ইতিহাসের সেরা ‘বিবিসি’ ত্রয়ী । চলতি ২০২২-২৩ মৌসুমের আগ পর্যন্ত ছিলেন রিয়েল শিবিরেই । যদিও শেষ কয়েকবছর ইনজুরি আর ফর্মহীনতার কারণে জায়গা হারিয়েছিলেন সেরা একাদশে । ২০২১-২২ মৌসুমে তো মাঠে নামার সুযোগ পেয়েছিলেন সাত ম্যাচে । এছাড়া ২০২০-২১ মৌসুমে ধারে খেলেছেন পুরনো ক্লাব টটেনহ্যামে । সেখানে দ্বিতীয় দফায় ধারের খেলোয়াড় হিসেবে একমাত্র মৌসুমে অবশ্য ছিলেন নিয়মিত । খেলেছেন সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ৩৪ ম্যাচ , করেছেন ১৬ গোল । বলা যায় , টটেনহ্যাম থেকে  পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে আসা বেল টটেনহ্যামেই পেয়েছেন নতুন জীবন ।

রিয়েল মাদ্রিদে আট মৌসুমে  ২৫৮ ম্যাচে ১০৬ গোল করেছেন । এসিস্ট আছে ৬৭টি । সব মিলিয়ে ক্লাব ক্যারিয়ারে বেলের গোলের সংখ্যা ৫৫৩ ম্যাচে ১৮৫টি । আর এসিস্ট ১৩৯টি । চ্যাম্পিয়ন্স লীগেও রিয়েল আর স্পার্সদের হয়ে ৬৬ ম্যাচে ২০ গোল ১৭ এসিস্টের মালিক বেল । জিতেছেন পাঁচটি চ্যাম্পিয়ন্স লীগসহ ১৭ শিরোপা । ২০১৮ সালে পেয়েছেন ফিফা ক্লাব ওয়ার্ল্ড কাপের ‘গোল্ডেন-বল’ । ছিলেন ২০১২-১৩ মৌসুম প্রিমিয়ার লীগের বর্ষসেরা ফুটবলার ।

বর্তমান সময়ে বেলের মতো সফল ক্যারিয়ার খুব কম খেলোয়াড়ের আছে । সেটা আন্তর্জাতিক আর ক্লাব , দুই ক্ষেত্রেই । তারচেয়ে বড় কথা , নিজ দেশের ফুটবলকে তিনিই এনে দিয়েছেন সেরা সময় । চলতি ২০২২ সালে জাতীয় দলের হয়ে ৮ ম্যাচে ৪ গোল করেছেন । মানে দাঁড়ায় , বিশ্বকাপে তিনি যাচ্ছেন পুরনো বেল হয়ে । যা প্রতিপক্ষদের জন্য আগাম দুঃসংবাদ বটে ।

বর্তমান দলে বড় তারকাঃ

বিশ্বকাপে সবাইকে আলাদাভাবে চোখ রাখতে হবে অ্যারন রামসের দিকে । ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক অভিষেকের পর খেলেছেন ৭৫ আন্তর্জাতিক ম্যাচ । করেছেন ২০ গোল । ২০১২ সালে গ্রেট ব্রিটেনের অলিম্পিক দলেও ছিলেন । ছিলেন সর্বশেষ দুইটি ইউরো আসরে দলের অন্যতম কাণ্ডারি । যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তিনিও ভুগেছেন ইনজুরিতে । সর্বশেষ ইউরো বাছাইয়ের বেশীরভাগ ম্যাচ মিস করেছেন ইনজুরির কারণে । শেষ পর্যন্ত খেলেছেন চূড়ান্ত পর্বে । তুরস্কের বিপক্ষে গোল করে দলের জয়ে অবদানও রেখেছেন । ২০২২ সালে অবশ্য জাতীয় দলের জার্সিতে চার ম্যাচ খেলেও কোন গোল পাননি । তবে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে তিনটি গোল আছে তার ।কার্ডিফ সিটি , আর্সেনাল , নটিংহ্যাম ফরেস্ট , জুভেন্টাস , রেঞ্জার্স হয়ে রামসে এখন খেলছেন ফ্রান্সের নিস ক্লাবে । ক্লাব ক্যারিয়ারে ৪৯৬ ম্যাচে তাঁর গোলের সংখ্যা ৭৬ ।

জাতীয় দলের হয়ে সর্বোচ্চ ১০৯ ম্যাচ খেলা ক্রিস গুন্টারকে দেখা যাবে বিশ্বকাপে । তিনি ওয়েলসের জার্সিতে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সেঞ্চুরিয়ান । মুলত ফুলব্যাক হলেও তাঁর আছে আক্রমণের মানসিকতা । ক্লাব ফুটবলে আছে ৫৯০ ম্যাচের বিশাল অভিজ্ঞতা । ২০১৭ সালের নিজ দেশের বর্ষসেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন ।

ওয়েলসের আরেক অভিজ্ঞ তারকা ওয়েন হেন্সি । খেলেছেন দেশের হয়ে ১০৬ ম্যাচ । ইংলিশ ক্লাব ক্রিস্টাল প্যালেসের হয়ে ১৩২বার পোস্টের নীচে দাঁড়িয়েছেন । চলতি মৌসুমে যোগ দিয়েছেন নটিংহ্যাম ফরেস্টে ।

বর্তমান স্কোয়াডঃ

ওয়েলসের ম্যানেজার হিসেবে ২০২০ সালে দায়িত্ব নিয়েছেন রব পেইজ । তাঁর অধীনে বিশ্বকাপ বাছাই পেরুনো ছাড়াও ওয়েলস খেলেছে সর্বশেষ ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ । যা থেকে তিনি পেয়েছেন বড় আসরে খেলার অভিজ্ঞতা । ওয়েলস জাতীয় দলের হয়ে ৪১ ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা থাকা পেইজের অধীনে ২৮ ম্যাচে ১০ জয় পেয়েছে ওয়েলস । ড্র আর পরাজয় নয়টি করে ।

বিশ্বকাপে রব পেইজ ৪-৪-২ ফর্মেশনে দলকে খেলাবেন বলে ধারণা । কারণ এটাই তাঁর পছন্দের ফর্মেশন । সেই ক্ষেত্রে গোলরক্ষক হিসেবে অভিজ্ঞ ওয়েন হেন্সির সাথে লড়াই হতে পারে ড্যানি ওয়ার্ডের । কারণ সাম্প্রতিক সময়ে ওয়ার্ড নিয়মিত দাঁড়াচ্ছেন লিয়েস্টার সিটির পোস্টের নীচে । অন্যদিকে ৩৫ বছরের হেন্সি চলতি মৌসুমে নটিংহ্যামে যোগ দিলেও একটি ম্যাচেও সুযোগ পাননি । ইতোমধ্যে জাতীয় দলে ২৬ ম্যাচ খেলেছেন ওয়ার্ড । বিশ্বকাপে গোলরক্ষক বাছাই করার ক্ষেত্রে পেইজের নিতে হবে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত ।

রক্ষণে ক্রিস গুন্টার , নিকো উইলিয়ামস , জো রন্ডন থাকতে পারেন সেরা একাদশে । মধ্যমাঠে অ্যারন রামসে ফিট থাকলে কোন চিন্তা নেই তাঁর জায়গা পাওয়া নিয়ে । সাথে ৭২ আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা জো অ্যালেন সঙ্গী হবেন ।  এছাড়া  এমপাডু কিংবা জেমস ডেভিস থাকবেন ।

দুই উইঙ্গারের একজন হিসেবে গ্যারেথ বেলকে নিয়ে কোন সংশয় নেই । বিপরীতদিকে তাঁর সঙ্গী হতে পারেন ড্যানিয়েল জেমস । এছাড়া ফরোয়ার্ড হিসেবে বার্নান জনসন , কেইফার মুর আর মার্ক হ্যারিসের মধ্যে যে কোন দুইজন চলে আসবেন একাদশে ।

আবার ৪-৩-২-১ ফর্মেশনে খেলালে ওয়েলসের একাদশ হবে ভিন্নরকম ।যা সাম্প্রতিক সময়ে খেলিয়েছেন পেইজ । আসলে একাদশ নির্বাচন বিষয়টা নির্ভর করছে খেলার আগে কোচের কৌশলের উপর ।

সাম্প্রতিক পারফর্মেন্সঃ

চলতি বছরের মঝামাঝি সময়ে ওয়েলস দল ব্যর্থ হয়েছে উয়েফা নেশন্স লীগে । আসরে টপ টায়ারের গ্রুপ-৪ থেকে চার দলের মধ্যে পেয়েছে চতুর্থ স্থান । বেলজিয়াম , হল্যান্ড আর পোল্যান্ডের গ্রুপ থেকে মাত্র এক পয়েন্ট পেয়েছে ওয়েলস । সেটিও অবশ্য বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট বেলজিয়ামের বিপক্ষে । কিন্তু বাকী চার ম্যাচে পরাজয় নিয়ে ওয়েলস নেমে গেছে টায়ার ‘টু’তে ।

২০২২ সালে সব মিলিয়ে ওয়েলস ম্যাচ খেলেছে ৯টি । যার মধ্যে হার পাঁচ ম্যাচে । জয় দুটি ম্যাচে । ড্র বেলজিয়াম আর চেক প্রজাতন্ত্রের বিপক্ষে । সব মিলিয়ে বিশ্বকাপের আগে খুব ভাল অবস্থায় আছে ওয়েলস এমনটা বলার উপায় নাই ।

বিশ্বকাপে লক্ষ্যঃ

বড় আসরে বড় চমক দেখাতে অভ্যস্ত ওয়েলসকে নিয়ে আগাম ভবিষ্যৎবাণী করার উপায় নেই । তবে ‘বি’ গ্রুপে ইংল্যান্ড , আমেরিকা আর ইরানের সাথে টক্কর দিয়ে নক আউটে খেলার সম্ভাবনা তাদের অনেক বেশী । গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী দল ইংল্যান্ড সন্দেহ নেই । তারা বিশ্বকাপের অন্যতম ফেভারিট ।তবে ব্রিটিশ প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ১৪ বার জয়ের রেকর্ড আছে ওয়েলসের । হেরেছে অবশ্য ৬৮টি ম্যাচে । ড্র ১৪বার । যদিও ২০১১ সাল থেকে টানা তিন ম্যাচে ওয়েলস হারাতে পারেনি ইংলিশদের । তবু অতীত পরিসংখ্যান বলছে , ইংল্যান্ডকে চমকে দেবার অভ্যাস ভালভাবেই  জানা আছে ওয়েলসের ।

 ওয়েলস ফিফা র‍্যাংকিংয়ে যদিও আমেরিকার চেয়ে পিছিয়ে আছে তিনধাপ । কিন্তু ইউরোপের গতিশীল ফুটবলের কাছে আমেরিকা কতটুকু কি করতে পারে , সেটা প্রশ্ন । এছাড়া ইরানের বিপক্ষেও ওয়েলস ফেভারিট হিসেবে নামবে । যদিও র‍্যাংকিং বলছে ১৯ নাম্বারে থাকা ওয়েলসের ঠিক পেছনেই অর্থাৎ ২০ নাম্বারে ইরান । তাই কাছাকাছি থাকা তিন দলের টক্কর হবে উপভোগ্য ।

আগামী ২১ নভেম্বর আমেরিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে ওয়েলসের বিশ্বকাপ । ২৫ নভেম্বর বেলদের খেলা ইরানের সাথে । ২৯ নভেম্বর ওয়েলসের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড ।

স্কোয়াডঃ 

গত এক বছরে ওয়েলসের হয়ে খেলা ফুটবলারদের মধ্যে যে ২৬ তারকা যেতে পারেন কাতার বিশ্বকাপে , তারা হচ্ছেন –

গোলরক্ষকঃ – ওয়েন হেন্সি , ড্যানি ওয়ার্ড , টিম কিং

রক্ষণভাগ- ইথান এমপাডু , ক্রিস মেফাম , বেন ডেভিস , ক্রিস গুন্টার , কনর রবার্টস , জো রন্ডন , নিকো উইলিয়ামস , নিস নরিংটন-ডেভিস

মধ্যমাঠ – জো অ্যাল্যান , অ্যারন রামসে , হ্যারি উইলসন , জনি উইলিয়ামস , সর্বা থমাস , রুবেল কলউইল , ডিলান লেভিট , জো মোরেল

আক্রমণভাগ- গ্যারেথ বেল , ড্যানিয়েল জেমস , কেইফার মুর , টেইলর রবার্টস , ব্রেনান জনসন , মার্ক হ্যারিস , নাথানবোর্ডহেড

আহসান/বিশ্বকাপ-০৬