Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

সাবিনাদের লক্ষ্য হোক আরও বিস্তৃত

আহসান হাবীব সুমন/ ক্রীড়ালোকঃ

সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ । মেয়েরা প্রথমবারের মতো জিতে নিয়েছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা । নেপালের কাঠমুণ্ডুতে ফুটবলের এই জয়ে আনন্দে উত্তাল সারাদেশের মানুষ । দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের শুভেচ্ছাবার্তায় সিক্ত হচ্ছে পুরো দল । চলছে নারী ফুটবলারদের রাজকীয় সংবর্ধনা দেয়ার প্রস্তুতি ।

নারীদের সাফ ফুটবলে পূর্ববর্তী পাঁচ আসরে ছিল ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য । ভারতকে ডিঙ্গিয়ে ২০২২ সালের আগে কেউ জিততে পারেনি শিরোপা । কিন্তু এবার ভারতকে গ্রুপ পর্বে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে বাংলাদেশের মেয়েরা । সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভারতের মেয়েরা । হেরে যায় নেপালের বিপক্ষে সেমিফাইনালে । অন্যদিকে , বাংলাদেশ সেমিতে ছেলেখেলা করে ভূটানকে নিয়ে ।

কাঠমুণ্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে উজ্জীবিত বাংলাদেশের সামনে দাঁড়াতে পারেনি নেপালের মেয়েরা । হিমালয়ের কন্যারা হেরেছে ১-৩ গোলে । সাফ নারী ফুটবলের ইতিহাসে পাঁচবার ফাইনালে উঠেও শিরোপা জেতা হয় নি নেপালের । আর ২০১৬ সালের পর দ্বিতীয় ফাইনালে বাজিমাৎ করেছেন সাবিনা খাতুন এন্ড কোংরা ।

সাবিনা খাতুন তো এখন বাংলাদেশের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো । টুর্নামেন্টের পাঁচ ম্যাচে দুই হ্যাট্রিকসহ আট গোল করে তিনি আসরের সেরা খেলোয়াড় আর সেরা গোলদাতা । বাংলাদেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী আন্তর্জাতিক গোলের মালিক । ৪৬ ম্যাচে তার গোলের সংখ্যা ৩১টি । দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ফরোয়ার্ড বালা দেবীর আছে ৫২ গোল । নেপালের সাবিত্রা ভাণ্ডারীর আছে ৪০টি আন্তর্জাতিক গোল । তবে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ১৯০ গোল নিয়ে সর্বকালের সেরা ক্যানাডার ক্রিস্টিন সিংক্লেয়ার । আর এশিয়ায় জর্ডানের মাইশা জাবারাহর গোলের সংখ্যা ১৩০টি । তিনি আছেন তালিকার তৃতীয় অবস্থানে ।

সাবিনা খাতুনের আছে রোনালদোর মতো গোলক্ষুধা । তিনি হারতে নারাজ । বাংলাদেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে মালদ্বীপ আর ভারতের ঘরোয়া আসরে করে এসেছেন বহু গোল । নারী-পুরুষ যে কোন বিভাগে তিনিই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী সাড়ে তিনশোর বেশী গোল করেছেন । তার ক্যারিয়ারে গোলের সংখ্যা আরও বেশী বাড়ত । যদিও মেয়েরা নিয়মিত মাঠে খেলার সুযোগ পেত । হাতে গোনা টুর্নামেন্ট ছাড়া বাংলাদেশের মেয়েদের তো আন্তর্জাতিক ফুটবল খেলার সুযোগ ছিল না । এমনকি , দেশে নারীদের ঘরোয়া লীগ ২০১১ সালে শুরু হলেও নিয়মিত না । খেলা হয়েছে চার মৌসুম ।

বাংলাদেশের জাতীয় দলের পক্ষে ২০০৯ সালে অভিষেকের পর খেলেছেন মাত্র ৪৬ ম্যাচ । এমন না , তিনি জাতীয় দল থেকে বাদ পড়েছেন । বরং জাতীয় দলের নিয়মিত সদস্য তিনি । খেলেছেন দেশের হয়ে সবচেয়ে বেশী আন্তর্জাতিক ম্যাচ । যেখানে নেপালের সাবরিতা ২০১৪ সাল থেকেই খেলছেন ৪১ ম্যাচ ।

অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ায় নারীদের ফুটবল এখনো পেশাদার রুপ পায় নি ।বাংলাদেশ তো আরও পিছিয়ে । বলতে গেলে , এখনও শৈশবের হাঁটা শেখার মধ্যেই আছে মেয়েদের পেশাদার লীগ । কিন্তু এরমধ্যেই উঠে এসেছেন সাবিনা , কৃষ্ণা , মারিয়া মান্ডা , সিরাত জাহান , শামসুন্নাহারের মতো ফুটবলার । আর্থসামাজিক প্রতিকুলতা পেরিয়া যাদের ফুটবলার হয়ে বেড়ে ওঠা (সে এক ভিন্ন আলোচনা) । শুধু বলা যায় , বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের প্রত্যেকের গল্প দীর্ঘ সংগ্রামের । তাই এই মেয়েদের সাফ ফুটবলে শিরোপা জয় অবশ্যই বিশেষ কিছু ।

বাংলাদেশের নারীরা সাফ ফুটবলের শিরোপা জেতায় প্রাণঢালা অভিনন্দন । সোনার-কন্যাদের এখন কুর্নিশ করতে তৈরি সারাদেশ । কিন্তু এক সময় এই উচ্ছাস থিতিয়ে যাবে । তখন কি হবে ? আশি-নব্বই দশকের ফুটবল উন্মাদনার যুগে বাংলাদেশের ছেলেরা ২০০৩  সালে সাফের ‘মুকুট’ জিতেছিল । তারপর আর পারে নি । পেছাতে পেছাতে বাংলাদেশের ছেলেরা এখন ফুটবল র‍্যাংকিং তলানিতে । ক্রমাগত ব্যর্থতায় ছেলেদের ফুটবল দেখতে মাঠে যাওয়া দর্শক এখন বাইনুক্যুলার দিয়ে খুঁজতে হয় । সেই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন মেয়েদের ফুটবলকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করার দায়িত্ব বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের ।

মেয়েদের ফুটবলে সবচেয়ে বড় সুবিধা , বয়সভিত্তিক দল থেকে তারা একসাথে খেলছেন । এই দলটার অনেকেই আবার বয়সে তরুণ । যেমন – মারিয়া মান্ডা ১৯ , কৃষ্ণা রাণী ২১ , সপ্না ২১ । তাদের সামনে এখনও বেশ কয়েকবছর খেলা পড়ে আছে । তাই কোচ গোলাম রাব্বানি ছোটন আর পল স্মলিদের পরিশ্রমে গড়ে ওঠা দলটির আগামী টার্গেট হতে হবে এশিয়ান লেভেল ।

নারীদের ফুটবলে বাংলাদেশের বর্তমান ফিফা র‍্যাংকিং ১৪৭ । কিন্তু সেটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ কম খেলার কারণে খুব বেশী বাড়ে নি । সাম্প্রতিক সময়ে র‍্যাংকিয়ে এগিয়ে থাকা ভারত , নেপালদের হারিয়েছে বাংলাদেশ । হারিয়েছে মালয়শিয়াকে । সাফল্য প্রত্যাশা বাড়ায় । তাই বাংলাদেশের মেয়েরা এখন সাফের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়ান লেভেল নিজেদের প্রমাণ করবে – এমন আশা করা বাড়াবাড়ি কিছু না ।

এশিয়ান ফুটবলে চীন , জাপান , কোরিয়া , অস্ট্রেলিয়া অনেক বেশী শক্তিধর । আছে থাইল্যান্ড , চাইনিজ তাইপে , মিয়ানমার , ভিয়েতনাম , ইরানের মতো দেশ । সর্বশেষ ভারতের মাটিতে ২০২২ সালের নারী এশিয়া কাপের ১২টি দেশের মধ্যে লড়াইয়ে যাদের প্রায় সবাই ছিল । আসরে নবমবারের মতো শিরোপা জিতেছে চীন । যাদের ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলে খেলার রেকর্ড আছে ।

বাংলাদেশের নারী ফুটবলে এখন প্রতিভার অভাব নেই । গোলরক্ষক পজিশন থেকে রক্ষণ , মধ্যমাঠ কিংবা ফরোয়ার্ড লাইনে আছে নির্ভর করার মতো ফুটবলার । গোলরক্ষক রুপনা চাকমা পাঁচ ম্যাচে শুধু ফাইনালে এক গোল হজম করেছেন। হয়েছেন আসরের সেরা গোলরক্ষক । স্বপ্না আর কৃষ্ণা করেছেন চারটি করে গোল । মাশরুরা , সাহ্মসুন্নাহার , ঋতুপর্ন , মনিকা , আঁখি – প্রত্যেকে নিজ নিজ পজিশনে দারুণ দক্ষ । ফুটবল গোলের খেলা । ছেলেদের ফুটবলে যেমন গোল করার কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না । মেয়েদের ফুটবলে তেমন নয় । প্রয়োজনের সময় ডিফেন্স কিং মধ্যমাঠ থেকে গোল করতে সক্ষম আঁখি , শামসুন্নাহার , মাশরুরা , সানজিদা আর মারিয়ারা । এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি । তাই এই দলটাকে পরিচর্যার মাধ্যে আরও শানিত করার অনেক সুযোগ আছে ।

এখনই বাংলাদেশ এশিয়া কাপ খেলবে , এমন স্বপ্ন দেখার কারণ নেই । কিন্তু এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশ এগিয়ে গেলে নিকট ভবিষ্যতে সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়াও বিচিত্র না । কারণে বাংলাদেশের এই মেয়ে ফুটবলারদের প্রতিভা আছে । আছে জয়ের ক্ষুধা । সংগ্রামের মানসিকতা আর শিক্ষা পেয়েছে নিজেদের জীবন থেকে । তাই এখনই সময় , মেয়েদের ফুটবলে সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে তাদের নিয়মিত মাঠে রাখার ব্যবস্থা করা । নিয়মিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ পেলে এই মেয়েরা করে দেখাতে পারবে অনেক কিছু , সেটা প্রমাণ হয়েছে সাফ আসরেই ।

আহাস/ক্রী/০০১