Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

পিএসজি ছেড়ে বার্সেলোনাতেই ফিরছেন মেসি ?

আহসান হাবীব সুমন/ক্রীড়ালোকঃ

লিওনেল মেসি কোনদিন বার্সেলোনা ছাড়বেন , এমনটা হয়ত ফুটবল ভক্ত থেকে শুরু করে খোদ মেসিও ভাবে নি । কিন্তু সেই অভাবনীয় কাজটাই মেসি ২০২১ সালে মেসি করেছেন বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যোগ দিয়ে । তাতে মেসির দায় যতটা না ছিল , তারচেয়ে বেশী ছিল বার্সেলোনার অনাগ্রহ আর অক্ষমতা !

মেসির ফুটবলার হয়ে গড়ে ওঠা তো বার্সেলোনাতেই । মাত্র ১৩ বছর বয়সের মেসিকে লালন করে বিশ্বসেরা বানিয়েছে বার্সেলোনাই । ছেলেবেলা থেকে হরমোন রোগে ভোগা চিকিৎসা থেকে শুরু করে যাবতীয় দায়িত্ব পালন করায় মেসিও ছিলেন বার্সার প্রতি কৃতজ্ঞ । খেলোয়াড়ি জীবনের নানা সময়ে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন , বার্সেলোনাতেই শেষ করবেন ক্যারিয়ার । স্পেনের বার্সেলোনা তাঁর দ্বিতীয় ‘ঘর’ । এমন কি নিজের সন্তানদের ‘কাতালান আর্জেন্টাইন’ বলে পরিচয় দিতে ভালবাসেন মেসি ।

২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে এক ট্রায়ালেই বার্সেলোনা কর্তাদের মন কেঁড়ে নেন মেসি । চুক্তিবদ্ধ হন বার্সেলোনার একাডেমী ‘লা মেসিয়া’ র সাথে । একই সাথে লা মেসিয়ায় চলে মেসির চিকিৎসা আর ফুটবলার হিসেবে গড়ে ওঠার পরিচর্যা । এরপর ধাপে ধাপে বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে ২০০৪-০৫ মৌসুমে মেসির পেশাদার অভিষেক হয় বার্সেলোনার মুল দলে । মাত্র ১৭ বছর ৩ মাস আর ২২ দিনে লা লীগায় স্পানিওলের বিপক্ষে ৮২ মিনিটে মাঠে নামেন মেসি । সেই মৌসুমে সব মিলিয়ে নয়টি ম্যাচে মাঠে নামার সুযোগ পান আর্জেন্টিনার মহাতারকা , প্রতিটা ম্যাচেই তিনি ছিলেন বদলী খেলোয়াড় । সেই মৌসুমেই উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে শাখতার দনেস্কের বিপক্ষে ইউরোপিয়ান প্রতিযোগিতায় প্রথম মাঠে নামেন তিনি । সেই মৌসুমেই আলবেসেটের বিপক্ষে রোনালদিনিওর এসিস্টে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম পেশাদার গোলের দেখা ।

শুরু থেকেই কোচ ফ্রাংক রাইকার্ডের মন জিতে নেয়া মেসি পরের মৌসুমে জায়গা করে নেন মুল একাদশে । খেলেন সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ২৫ ম্যাচ , করেন ৮ গোল । তারপর থেকে তো কখনও পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি তাকে । বার্সায় সিনিয়র দলের হয়েই কাটিয়েছেন ২১টি মৌসুম । কি পান নি তিনি এই সময়ে ? দশটি লা লীগা , সাতটি করে স্প্যানিশ সুপার কোপা আর কোপা ডেল রে , চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগ , তিনটি করে উয়েফা সুপার কাপ আর ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ – এসেছে এই সময়ে । ব্যক্তিগত ভাবেও বার্সেলোনার জার্সিতে গড়েছেন রেকর্ডের পর রেকর্ড । এক ক্লাবের হয়ে ৭৭৮ ম্যাচে ৬৭২ গোলের বিশ্বরেকর্ড আর্জেন্টিনার খুদে যাদুকরের । জিতেছেন সাতটি রেকর্ড ব্যালন ডি অর’ (একটি পিএসজিতে যোগ দেয়ার পরে এলেও পেয়েছিলেন বার্সা আর আর্জেন্টিনার হয়ে পারফর্মেন্সের সুবাদে) । পেয়েছেন দুইটি ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার । সাথে স্প্যানিশ লা লীগার সেরা গোলদাতার স্বীকৃতি ‘পিচিচি’ জিতেছেন রেকর্ড আটবার । ছয়টি ‘ইউরোপিয়ান গোল্ডেন শ্যু’ জিতেও গড়েছেন নতুন রেকর্ড ।

এছাড়া ২০১২ সালে ৯১ গোল করে মেসি গড়েছেন এক ক্যালেন্ডার বর্ষে সবচেয়ে বেশী গোলের রেকর্ড । এই ক্ষেত্রে তিনি ভেঙেছেন ১৯৭২ সালে জার্মানির কিংবদন্তী গাড মুলারের রেকর্ড । সব মিলিয়ে শুধুমাত্র বার্সেলোনায় খেলে মেসি পরিণত হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ে । একই সাথে তিনি ছিলেন বার্সেলোনার সবচেয়ে প্রভাবশালী ফুটবলার । বার্সেলোনায় এমন রমরমা অবস্থায় মেসি কখনও ক্লাব ছাড়বেন , এমনটা ভাবতে পারে নি কেউ ।

কিন্তু সেই মেসিই ২০২১-২২ মৌসুমে বার্সেলোনা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন ফ্রান্সের চ্যাম্পিয়ন ক্লাব পিএসজিতে । যদিও স্বেচ্ছায় নয় , বরং আর্থিক কারণ দেখিয়ে বার্সেলোনাই ছেড়ে দেয় তাদের ইতিহাসের সেরা ফুটবলারকে । বার্সা ছাড়ার সময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে মেসি বলেছিলেন , ‘ আমি কখনো ভাবিনি যে এভাবে বিদায় নিতে হবে। এখানকার সবাইকে মনে থাকবে আমার। যে ভালোবাসা এখানে আমি পেয়েছি তার সাথে কোনকিছুর তুলনা হয়না। ‘

বার্সেলোনায় নিজের শেষ সংবাদ-সম্মেলনে মেসি আরও জানিয়েছিলেন , ‘ এটাই(বার্সেলোনা) আমার বাড়ি। আমি একদিন এখানে ফিরে আসবো বলে আমার সন্তানদের কথা দিয়েছি । ‘

বার্সা ছেড়ে পিএসজিতে মেসির প্রথম মৌসুম খুব ভাল যায় নি । সব মিলিয়ে গোটা মৌসুমে তিনি জালের দেখা পেয়েছেন মাত্র ১১বার । যা তাঁর শুরুর দুই মৌসুমের পর সবচেয়ে কম । ফরাসী লীগ ওয়ানে তিনি করেছিলেন মাত্র ৬ গোল । সুযোগ পান নি লীগ ওয়ানের বর্ষসেরা দলে । যদিও জিতেছিলেন পিএসজির হয়ে লীগ ওয়ান শিরোপা , কিন্তু সেখানে মেসির অবদান উল্লেখে আসে না । মোট কথা , পিএসজিতে মেসি হয়ে উঠতে পারেন নি বার্সেলোনার মত অপরিহার্য ।

পিএসজির সভাপতি নাসের আল খেলাইফি অবশ্য মনে করছেন , দীর্ঘদিন বার্সেলোনায় কাটিয়ে আসা মেসির সমস্যা হয়েছে প্যারিসের নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে । ২০২২-২৩ মৌসুমে মেসি সেরাটাই দেবেন পিএসজির জন্য ।

২০২২-২৩ মৌসুমেই মেসির সাথে পিএসজির চুক্তি শেষ হচ্ছে । দুই বছরের চুক্তিতেই তিনি প্যারিসের ক্লাবে এসেছিলেন । চুক্তি শেষ হয়ে গেলে কি হবে ? মেসির সাথে কি চুক্তি বাড়াবে পিএসজি ? এটা অবশ্য নির্ভর করছে , ২০২২-২৩ মৌসুমে পিএসজির সাফল্যের উপর । কারণ নেইমার , মেসিদের পিএসজি দলেই এনেছে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সাফল্যের আশায় , যা এখনও তাদের অধরা । নেইমার তবু একবার পিএসজিকে চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনালে তুলেছেন । আর মেসি নিজের প্রথম মৌসুমেই নক আউট পর্বে পেনাল্টি মিস করে হয়েছেন বিদায়ের কারণ ! তাই খেলাইফি যত মুগ্ধতার কথাই বলুন না কেন , চ্যাম্পিয়ন্স লীগে সাফল্য না পেলে পিএসজিতে তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে সন্দেহ নেই ।

তবে আসন্ন মৌসুমে কি হবে , সেটা পরের বিষয় । আপাতত মেসিকে আবারও বার্সেলোনায় পাওয়ার আশায় বসে আছেন কোচ জাভি হার্নান্দেজ , যিনি এক সময় ছিলেন মেসির সতীর্থ । ২০২১-২২ মৌসুমটি বার্সার কেটেছে শিরোপাহীন । লীগের মাঝামাঝি সময়ে বেহাল বার্সার হাল ধরেন জাভি । শেষ পর্যন্ত বার্সাকে দ্বিতীয় স্থান এনে দিয়ে অনেকটাই অসাধ্য সাধন করেছেন জাভি ।

তবে ২০২২-২৩ মৌসুমের জন্য এক দুর্দান্ত স্কোয়াড গড়ে তোলার পথে বার্সেলোনা । রাফিনহা , রবার্ট লেভেন্ডস্কিদের সাথে আনসু ফাতিহ , উসমান ডেম্বেলে , গাভি , পেদ্রি , আরাউহো , জর্দি আলাবা , মেম্ফিস ডিপে আর পিয়েরে এমেরিক ওবামাইয়াংদের নিয়ে সর্বশেষ মৌসুমের গ্লানি ভুলতে মরিয়া বার্সা । সেই সাথে ফেরাতে চায় দলের সোনালী সময়ের কাণ্ডারি মেসিকেও । যদিও চুক্তি থাকায় চলতি মৌসুমে আর পিএসজি ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই বার্সার সাবেক তারকার । তবে ২০২৪ সালে আবার ঘরের ছেলেকে ঘরে ফেরাতে আশাবাদী কাতালানরা ।

এই নিয়ে দুদিন আগেই বার্সার প্রেসিডেন্ট হুয়ান লাপোর্তা প্রকাশ্যেই বলেছেন মেসিকে ফেরানোর ইচ্ছার কথা। তার মতে, বার্সেলোনায় এই ফরোয়ার্ডের অধ্যায় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ইএসপিএনকে লাপোর্তা বলেছেন, ‘মেসি বার্সার জন্য সব কিছু করেছে। সে ইতিহাসের সেরা হয়ে গেছে। তার তুলনা কেবল ইয়োহান ক্রুইফের সঙ্গেই হয়। যেমন আর্থিক পরিস্থিতিতে ক্লাবের দায়িত্বে এসেছিলাম, এমন কিছু একটা হতোই। তবে কোচ ও খেলোয়াড়দের চেয়ে ক্লাবের অবস্থান অনেক ওপরে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, মেসির বার্সেলোনা অধ্যায় শেষ হয়ে যায়নি। আমার মতে, এটি আমাদের দায়িত্ব যাতে এ অধ্যায় সবসময় খোলা থাকে, আরও ভালো কিছু যেনো হয় এবং কখনও এ অধ্যায় বন্ধ না হয়। যেভাবে শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, তার চেয়ে যেন ভালো হয়।’

মেসিকে ধরে রাখতে না পারায় এখনও দুঃখবোধ হয় লাপোর্তার। নিজেকে এখনও মেসির কাছে ঋণী মনে করেন বার্সা প্রেসিডেন্ট, ‘বার্সা সভাপতি হিসেবে আমার মনে হয় ক্লাবের যা প্রয়োজন ছিল, তাই আমি করেছি। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে ও একজন সভাপতি হিসেবে আমার মনে হয়, তার কাছে আমি ঋণী।’

এদিকে বার্সার কোচ জাভিও অনুরোধ করেছেন প্রেসিডেন্ট লাপোর্তোকে , যেন আগামী মৌসুমে মেসিকে ফিরিয়ে আনা হয় । এমন খবর দিয়েছে স্প্যানিশ গণমাধ্যম ‘ ডিরাইও স্পোর্টস’ । যে সংবাদের ভিত্তিতে অনেকেই মেসির বার্সেলোনায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে আশাবাদী । আর মেসি নিজেও বারবার বলেছেন , বার্সার জার্সিতেই তিনি ক্যারিয়ার শেষ করতে চান । আর তাছাড়া যে অর্থনৈতিক সমস্যায় বার্সেলোনা বাধ্য হয়েছিল মেসিকে ছাড়তে , সেটা অনেকটাই কেটে যাওয়ার পথে । তাই মেসি রাজী থাকলে আগামী মৌসুমে লা লীগার বেঁধে দেওয়া ‘স্যালারি ক্যাপ’ নিয়ম মেনেও বার্সা ফিরিয়ে আনতে পারবে তাদের সুপারস্টারকে ।

তবে এসব হিসেব বাস্তবে মিলবে কিনা সেটা জানার জন্য সবাইকে ২০২২-২৩ মৌসুমের শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে ।

আহাস/ক্রী/০০২