Download WordPress Themes, Happy Birthday Wishes

ম্যাচ ফিক্সিংয়ের বিনিময়ে বিপুল অর্থের সাথে দামী গাড়ি !

আহসান হাবীব সুমন/ক্রীড়ালোকঃ

নব্বই দশকের শুরু থেকেই ক্রিকেট খেলার বানিজ্যিক সম্প্রসারণ ঘটে বিশ্বব্যাপি । একদা ফুটবল , রাগবি , বাস্কেটবলের মত দলীয় খেলার সাথে তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা ক্রিকেট সেই সময় থেকেই  হতে শুরু করে জনপ্রিয় । বাড়তে থাকে টাকা-পয়সার ঝনঝনানি আর খেলাটির চাকচিক্য । সাদা পোশাকে দীর্ঘ সময় ধরে খেলা ক্রিকেট , যা ছিল মানুষের অনাগ্রহের কারণ । রঙ্গিন পোশাকে সীমিত ওভারের ক্রিকেট সেই তুলনায় মানুষের আগ্রহ জাগাতে সমর্থ হয় । আর হালের ধুম-ধারাক্কা টি-২০ ফরম্যাট তো বিরাট অংশের ক্রীড়ামোদী মানুষের কাছে সমাদর পাচ্ছে যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী ।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে , ক্রিকেট যত বেশী জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ততই যেন অন্ধকারে তলাচ্ছে অভ্যন্তরীণ পরিবেশ । ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করতে তৎপর হচ্ছে মাফিয়ারা । তারা প্রলুব্ধ করছে অন্য খেলার তুলনায় আয়ের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে থাকা ক্রিকেটারদের বাড়তি আয়ের ব্যবস্থায় , অবশ্যই সেটা অনৈতিক উপায়ে । যার হাত ধরে ক্রিকেট খেলায় এখন ‘ফিক্সিং’ শব্দটা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সমার্থক ।

ক্রিকেটে যত বেশী চাকচিক্য বাড়ছে , তত বেশী বাড়ছে ম্যাচ পাতানোর ঘটনা । গত দুই যুগে এমন কিছু ক্রিকেট-ফিক্সিং ঘটনা মানুষের সামনে এসেছে , যা রীতিমত চমকে দিয়েছে সবাইকে । দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ে নন্দিত থেকে নিন্দিত হয়ে পৃথিবী ছেড়েছেন । শুধু হ্যান্সি ক্রোনিয়ে নন , ক্রিকেটের ফিক্সিংয়ের সাথে নাম জড়িয়েছে হার্সেল গিবস , হেনরি উইলিয়ামস , মরিস ওদুম্বে , মার্লন স্যামুয়েলস , লু ভিনসেন্ট আর কুশল লুকারচ্চির মত নাম । এমনকি বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল আর সাকিব আল হাসানের মত তারকার গায়েও লেগেছে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কালিমা । এইসব ক্রিকেটারদের প্রত্যেকে কোন না কোনভাবে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের সাথে নিজেদের জড়িয়ে বিভিন্ন মেয়াদে নিষিদ্ধ হয়েছেন ।

তবে ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং ঘটনায় সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে ভারত আর পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা । বলা হয় , ক্রিকেটে ম্যাচ ফিক্সিং এসেছে এই দুই দেশের উৎসাহেই । ক্রিকেট ইতিহাসে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্য সর্বপ্রথম নিষিদ্ধ হন পাকিস্তানী গ্রেট সেলিম মালিক । সাবেক পাকিস্তান অধিনায়ক ১৯৯৪-৯৫ তে পাকিস্তানে অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজ চলাকালীন করাচি টেস্ট হারের জন্য দুই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন ও মার্ক ওয়াহকে ঘুষ দেন। বিষয়টি প্রমাণ হলে ২০০০ সালে তাকে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয়। এই অপরাধে জেলও খাটতে হয়েছিল মালিককে। অবশ্য রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে ২০০৮ সালে ক্রিকেট থেকে নিজের আজীবন নিষেধাজ্ঞা তুলতে সক্ষম হন মালিক।

মালিক ছাড়াও পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হওয়া ক্রিকেটারের তালিকা অনেক দীর্ঘ । আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের মধ্যে আতাউর রহমান , মোহাম্মদ আমির , মোহাম্মদ আসিফ , সালমান বাট আর দানিশ কানেরিয়া কলংকিত করেছেন ক্রিকেটকে । ম্যাচ ফিক্সিং করে নিষিদ্ধ হয়েছেন তারা প্রত্যেকে । এছাড়া ঘরোয়া ক্রিকেটে ম্যাচ পাতিয়ে সাজা পাওয়া পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের তালিকাটাও বিশাল । যাদের মধ্যে আছেন নাসির জামশেদ , শারজিল খান , খালিদ লতিফ , মোহাম্মদ নেওয়াজ , মোহাম্মদ ইরফান আর শাজাইব হাসানদের নাম ।

মাত্র দিন কয়েক আগে পাকিস্তানের সাবেক বোলার আকিব জাভেদ জানিয়েছেন , পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা সেই নব্বই দশকের শুরু থেকেই ম্যাচ ফিক্সিং করে আসছে ।

পাকিস্তানের ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য আকিব জাভেদ জানান , পাকিস্তানী ক্রিকেটাররা ম্যাচ পাতানোর বিনিময়ে দামী গাড়ি উপঢৌকন নিত । সাথে বড় অংকের টাকার লেনদেন তো থাকতই !

আকিব জাভেদ জানিয়েছেন , ১৯৮০ সালে পাকিস্তানের হয়ে একটি ওয়ানডে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা সেলিম পারভেজ ছিলেন সেই সময়ে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের হোতা । আকিব জানান , ‘সেলিম পারভেজ ম্যাচ পাতাতে দামি গাড়ি, লাখ লাখ রুপির লোভ দেখাত ক্রিকেটারদের। অনেকে লোভ সামলাতে না পেরে এতে জড়িয়ে পড়ত। কিন্তু এসব ব্যাপার জেনেও চুপ করে থাকতে হতো। যারা মুখ খুলত, তাদের ক্যারিয়ারই ধ্বংস করে দেওয়া হতো।’

আকিবের অভিযোগ দলের মধ্যে চলতে থাকা ম্যাচ ফিক্সিংসহ নানা অনৈতিক কাজের প্রতিবাদ করায় তাঁর ক্যারিয়ার প্রত্যাশিতভাবে বড় হয় নি । পাকিস্তানের হয়ে ২২ টেস্ট ও ১৬৩ ওয়ানডে খেলেছেন আকিব। টেস্টে ৫৪ ও ওয়ানডেতে ১৮২ উইকেটের মালিক এই ডানহাতি সুইং বোলার বর্তমানে কোচ হিসেবেও সুনাম কুড়িয়েছেন।

এদিকে ক্রিকেটের ম্যাচ ফিক্সিং ইস্যুতে ভারতের ‘কুকীর্তি’ আরও ভয়াবহ । ভারতের অন্যতম সফল অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন , অজয় জাদেজা , অজয় শর্মা , মনোজ প্রভাকর আর শ্রীশান্তের মত ক্রিকেটার হয়ে আছেন ক্রিকেটের কলংক । এছাড়াও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়াত অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ে ভারতে গিয়েই ম্যাচ ফিক্সিং ফাঁদে পড়েন । এদের বাইরে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে মনিশ মিত্র , চন্দ্র শুধিন্দ্রা , অমিত যাদব , অভিনাভ বালি , শালাভ শ্রীবাস্তব , অংকিত চৌহান , অমিত সিং আর সিদ্ধার্থ ত্রিবেদীরা ম্যাচ ফিক্সিং কাণ্ডে নিষিদ্ধ হয়েছেন বিভিন্ন মেয়াদে ।

ভারতের আইপিএলসহ অন্যান্য ঘরোয়া আসরেও লেগেছে ম্যাচ পাতানোর কলংক । বিশেষ করে টি-২০ আসরগুলোতে ম্যাচ ফিক্সিং এখন ভারতে মহামারী । দেশটিতে কিছুদিন আগেই ম্যাচ পাতানোর অভিযোগে কর্ণাটক লিগ বাতিল হয়েছে। এক দলের মালিক ও কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে তদন্ত চলছে। এমন ঘটনা ভারতের ক্রিকেট সম্পর্কে সবাইকে সন্দিহান করে তুলছে ।

শুধু ক্রি ঘরোয়া ক্রিকেট , আন্তর্জাতিক আসরেও ভারতের বিরুদ্ধে উঠছে একের পর এক পাতানো ম্যাচের অভিযোগ । সর্বশেষ ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাতানো ম্যাচ খেলে হেরেছে ভারত , এমন অভিযোগ এখন হয়ে উঠেছে শক্তিশালী ।

তবে ভারতের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় অভিযোগ করেছেন শ্রীলঙ্কার সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রী মাহিন্দানন্দা আলুথগামাগে । গত ১৮ জুন তিনি নিজ দেশের একটি টিভি চ্যানেলে জানান , ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালটি ভারতের কাছে বিক্রি করেছিল শ্রীলংকা । তবে তাতে খেলোয়াড়রা নয় , জড়িত শ্রীলংকা আর ভারতের ক্রিকেটের উচ্চমহল – এমন কথাও বলেছেন তিনি ।

ভারতের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার ২০১১ সালের সেই ফাইনাল নিয়ে তদন্তের দাবী করেছিলেন দেশটির বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গাও ।

এদিকে ভারতের বিপক্ষে ১৯৯৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ছাড়াও অনেক সিরিজ আর ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে । সম্প্রতি দিল্লী পুলিশের হাতে ধরা পড়া কুখ্যাত জুয়াড়ি সঞ্জীব চাওলা এই বিষয়ে চমকে দেয়া সব তথ্য দিচ্ছেন । তিনি এখনও দিল্লী পুলিশের হেফাজতে আছেন ।

এছাড়াও আইসিসির ম্যাচ ফিক্সিং তদন্তের সমন্বয়কারী স্টিভ রিচার্ডসন ফাটিয়েছেন আরও বড় বোমা । তিনি জানিয়েছেন , ভারতই নাকি বেশিরভাগ ফিক্সিংয়ের সাথে জড়িত । । তার ভাষ্যমতে, অধিকাংশ ম্যাচ পাতানোর সাথে আছে ভারত সংশ্লিষ্টতা। তবে সব খেলোয়াড়রাই যে এটা করে থাকেন তা নয়। বাজিকরদের বড় একটা অংশ ভারতীয় বলে নিশ্চিত করেছেন এই কর্মকর্তা।

রিচার্ডসন জানিয়েছেন , ‘আমরা ৫০টির মতো ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে তদন্ত করছি। যার বেশিরভাগেই ভারত জড়িত। ফিক্সিংয়ের সবশেষ পর্যায়ে গিয়ে আসে খেলোয়াড়রা। সমস্যা হচ্ছে যারা এই ফিক্সিংটা পরিচালনা করে, যারা খেলোয়াড়দের টাকা দেয় মাঠের বাইরে বসে। আমি ৮ জনের নাম দিতে পারব, যারা প্রতিনিয়ত খেলোয়াড়দের সঙ্গে ফিক্সিং নিয়ে কথা বলে থাকেন ।’

রিচার্ডসন জানান, ভারতে এ নিয়ে কোন আইন না থাকায় সমস্যা পোহাতে হচ্ছে আকসুকে।

সব মিলিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ায় ম্যাচ ফিক্সিং ঘটনায় মুল আসামীর কাঠগড়ায় এখন ভারত । যারা হঠাৎ করেই গত দুই যুগে ক্রিকেটের প্রধান মোড়ল বনে গেছে । সেটা মাঠের সাফল্যের সাথে সাথে আর্থিক দাপটেও । আইসিসি’তে ভারতের দাদাগিরি চলছে অনেকদিন । তবে ম্যাচ ফিক্সিং ঘটনায় এখন ভারতের ভাবমূর্তি নষ্ট হবার পথে । কারণ বিশ্বকাপ ফাইনাল কিংবা অন্য যে কোন আন্তর্জাতিক ম্যাচ কিংবা সিরিজে ক্রিকেটারদের জড়িয়ে পড়ার দায় বিসিসিআই এড়াতে পারে না । আবার শ্রীলংকার সাবেক ক্রীড়ামন্ত্রীর অভিযোগ সন্দেহের তীর ঠেলে দেয় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দিকেও । সব মিলিয়ে নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে ভারতের হঠাৎ সফল হওয়ার পেছনে অনেকেই মনে করছেন , ‘ডাল মে জরুর কুচ কালা হ্যায় ‘ ! আর সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের আইপিএল যে ক্রিকেট জুয়াড়িদের নতুন পথ দেখিয়েছে সেটা তো অনস্বীকার্য । যে কারণে অনেকেই দাবী করছেন , এই ধরণের ফ্রেঞ্চাইজি আসর বাতিলের । নতুবা কঠোর আইন করে এসব বিনোদনমুলক টুর্নামেন্টের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে , নইলে ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হয়ে পড়বে ।

আহাস/ক্রী/০০২