
ক্রীড়ালোক প্রতিবেদকঃ
তানজিম হাসান সাকিব । বাংলাদেশের জাতীয় ক্রিকেট দলে নতুন মুখ । এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে দুর্দান্ত জয়ের ম্যাচে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছে তাঁর । নিজেও ব্যাট-বলে বাংলাদেশের জয়ে রেখেছেন বড় ভূমিকা । কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শুরুতেই সাকিব জুনিয়র জড়িয়েছেন বিবাদে । দাবী উঠেছে , জাতীয় দল থেকে তানজিম সাকিবকে বহিষ্কারের ।
২০ বছর বয়সী তানজিম হাসান সাকিব বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ আইসিসি বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ছিলেন । এশিয়া কাপের স্কোয়াডে সুযোগ পান পেসার ইবাদত হোসেন ইনজুরিতে পড়ায় । পুরো আসরে ছিলেন রিজার্ভ বেঞ্জে । তবে ভারতের বিপক্ষে মাঠে নেমেই দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখিয়েছেন । বল হাতে নিয়েছেন ২ উইকেট । ব্যাট হাতে ৮ বলে ১টি করে চার-ছক্কায় করেছেন অপরাজিত ১৪ রান । বাংলাদেশ ম্যাচ জিতেছে ৬ রানে ।
ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচের পারফর্মেন্সের পর আলোচনায় চলে আসেন সাকিব জুনিয়র । ধারণা করা হচ্ছে , বিশ্বকাপ টাইগার স্কোয়াডে জায়গা হতে পারে তাঁর । কিন্তু সেই সম্ভাবনার মধ্যেই তানজিম সাকিবকে নিয়ে শুরু হয়েছে ‘নেতিবাচক’ বিতর্ক । যার কারণ তিনি নিজেই ।
তানজিম সাকিব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় । নিজের ফেসবুক ওয়ালে প্রায়শই পোস্ট করেন । সেখানে খেলাধুলা কিংবা নিজের ব্যক্তিগত বিষয়ের চেয়ে ধর্মীয় পোস্ট বেশী থাকে । সম্প্রতি তানজিম সাকিবের ফেসবুক ফলোয়ার বেড়েছে জাতীয় দলের খেলার কল্যাণে । স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ভেরিফায়েড পেইজে দেয়া পোস্টগুলো মানুষের চোখে পড়ছে অনেক বেশী । পুরনো পোস্ট চলে আসছে সামনে ।
২০২২ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে তানজিম সাকিব পোস্ট করেছিলেন , ‘স্ত্রী চাকরি করলে স্বামীর হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে সন্তানের হক আদায় হয় না, স্ত্রী চাকরি করলে তার কমনীয়তা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পরিবার ধ্বংস হয়, স্ত্রী চাকরি করলে পর্দা নষ্ট হয়, স্ত্রী চাকরি করলে সমাজ নষ্ট হয়।’
বলা হয়েছে, ‘অতএব মা-বোনেরা নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে স্বামীর আনুগত্য ও বাসায় অবস্থান করে রানির হালাতে অবস্থান করুন। অতএব মা-বোনেরা দুনিয়া কামাতে যেয়ে আখেরাত না হারিয়ে ঘরে অবস্থান করে স্বামী-সন্তানের খেদমত করে দুনিয়া ও আখেরাত দুটিই কামাই করতে পারবেন ইনশা আল্লাহ।’
পোস্টের শেষে একটি মাইক্রোফোনের ইমোটিকনসহ শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ জাকারিয়া (হাফিযাহুল্লাহ) নামটি লেখা আছে।
২০১৪ সালের ৫ ডিসেম্বর নিজের ওয়ালে তানজিম সাকিব লেখেন , ‘ ফেসবুকে দেখলাম অনেকে নিজেদের প্রফাইলে জাতীয় পতাকা দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর সম্মান করছে । আবার অনেকে বলছে সবাই নাকি ১৬ ডিসেম্বর এর দিন নাকি সবাই পতাকা দিয়ে রাখবে । এতে করে বাংলাদেশের কি উপকার হবে জানি না ! ‘
পোস্টের শেষ তানজিম সাকিব লেখেন , ইসলামে বিভিন্ন দিবস পালন করা নিষেধ । মুলত ১৬ ডিসেম্বর পালনকে নিরুৎসাহিত করতে সাকিব পোস্ট দেন । সাকিব নিজের পোস্টের যথার্থতা প্রমাণে ইসলামের আলোকে বিভিন্ন দলিল দিয়ে থাকেন । মুলত বিভিন্ন ইসলামিক পেইজের পোস্ট শেয়ার করেন তিনি ।
তানজিমের সাকিবের নারী বিষয়ক পোস্ট নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে । অনেকেই বলছেন , দেশের নারীরা যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন সাকিবের মত মন-মানসিকতার মানুষ সবাইকে নারী স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছেন । বাংলাদেশের সরকারপ্রধান নারী । দেশের বহু সর্বোচ্চ পদে নারীরা আসীন । নারী ক্ষমতায়নের নতুন যুগে বাংলাদেশ । সেখানে তানজিম সাকিবরা চলছেন উল্টো স্রোতে ।
তানজিম সাকিব একজন সেলিব্রিটি । তাঁকে চিনতে শুরু করেছে মানুষ । তাঁর কথায় সায় দিচ্ছে বহু মানুষ । আবার তাঁর পোস্টে নেতিবাচক কমেন্ট পড়ছে , এমন ঘটনাও কম না । তাঁর পোস্ট শেয়ার দিয়ে অনেকেই প্রতিবাদ করছেন । ইতোমধ্যে সাকিব জুনিয়র সরিয়ে নিয়েছে নারী বিসয়ক পোস্ট । কিন্তু তাঁর স্ক্রিন শট ভাইরাল । অনেকেই সাকিবকে জাতীয় দল থেকে বহিষ্কারের দাবী তুলেছেন ।
নেটিযেনদের তীব্র সমালোচনায় তানজিম সাকিব জানিয়েছেন , ‘আমি ইসলাম ধর্ম মেনে চলার চেষ্টা করি । ইসলাম আমাকে শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে সাহায্য করে। তাতে মানসিকভাবে আমি শক্ত থাকতে পারি। আমার মানসিকতা অন্যদিকে যায় না। একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিজের মানসিকতা ধরে রাখতে পারি। সুতরাং এটি আমাকে দুনিয়া এবং আখিরাত- দুইদিক থেকেই সাহায্য করছে। ‘
সমালোচনাকারীদের বক্তব্য , যে কেউ যে কোন ধর্মের অনুসারী বা অনুরাগী হতেই পারে । ধর্মের প্রতি অনুরাগ অস্বাভাবিক বা অন্যায় নয়, বরং এ মানুষের এক স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু তানজিম সাকিবের পোস্টে প্রতিফলিত হয়েছে একধরনের বিদ্বেষ—সোজা কথায়, নারীকে অধস্তন করার মানসিকতা। এটা মেনে নেয়ার মত না !
তানজিম সাকিবের পোস্ট উঠে আসে ৭১ টিভির আলোচনায় । ‘একাত্তর-জার্নাল’ নামের অনুষ্ঠানে অন লাইন এক্টিভিস্ট ইমতিয়াজ মাহমুদ জানান , ‘আমাদের দেশের ইসলামিক বক্তারা নারী বিদ্বেষ ছড়ায় । যা দেখে-শুনে অনেকেই প্রভাবিত হয় । তানজিমও তাদের একজন । এক সময় ক্রিকেটে বর্ণবাদের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিস্কার করা হয়েছিল । তানজিম সাকিবের পোস্টও একধরণের বর্ণবাদ । তবে ছেলেটার বয়স মাত্র ২০ বছর । তাঁর ক্যারিয়ার মাত্র শুরু । তাঁকে গ্রুমিং করে সঠিক শিক্ষা দেয়া দরকার। ‘
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিলের (আইসিসি) বৈষম্য বিরোধী নীতিমালায় বলা আছে, ‘বিশ্বের অন্যতম কঠিন খেলার এই নীতি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, বংশ, সংস্কৃতি, জাতিগত উৎস, জাতীয়তা, সেক্স ও জেন্ডার, যৌন অভিযোজন, অক্ষমতা, বৈবাহিক অবস্থা ও মাতৃত্বের অবস্থা নির্বিশেষে সব স্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রচার ও উৎসাহিত করার জন্য আইসিসি ও এর সদস্যদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করে। সেই সঙ্গে এটা নিশ্চিত করে যে, খেলাধুলায় কোনো বৈষম্যের স্থান নেই।’
অর্থাৎ আইসিসির নীতিবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন তানজিম সাকিব। শুধু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেই নয়, আইসিসির এসব নীতি ঘরোয়া ক্রিকেটেও প্রযোজ্য। মাঠের খেলায় এর শাস্তি হতে পারে আজীবন নিষেধাজ্ঞা।
তানজিম সাকিবের নারী-বিদ্বেষী পোস্টে অনেকেই ক্ষুব্ধ । কারণ বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল-ক্রিকেটসহ প্রায় সব ধরণের খেলাধুলায় অংশ নিচ্ছে । দেশের অর্থনীতির মুল স্তম্ভ গার্মেন্টস সেক্টর নারীকর্মী নির্ভর । তানজিব সাকিবের মত জনপ্রিয় ক্রিকেটার নারীবিদ্বেষী মন্তব্য করলে সেটা আপত্তিকর তো বটেই ।
এদিকে , তানজিম সাকিবকে নিয়ে সমালোচনা চোখে পড়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) । বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আমরা ওর সঙ্গে কথা বলছি। কথা বলে নিই, তারপর জানাব। ওর একটা ভুল হয়েছে, আমরা সেই বিষয়টা ওর কাছ থেকেই জানতে চাচ্ছি।’
আহাস/ক্রী/০০২